ছবি: পিটিআই।
সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার হইতে পুষ্পবৃষ্টি হইল। যদিও, থালা বাজানোর ন্যায় এই বিমান-শুভেচ্ছাতেও নকলনবিশি আছে— দিনকয়েক পূর্বেই বিমান উড়াইয়া করোনা-যোদ্ধাদের শুভেচ্ছা জানাইয়াছিল মার্কিন সেনাবাহিনীও। কিন্তু, আপত্তি সেই নকলনবিশিতে নহে, আপত্তির কারণ গভীরতর— সেনাবাহিনী করোনা-যোদ্ধাদের শুভেচ্ছা জানাইবে কেন? প্রতিষ্ঠান হিসাবে সেনাবাহিনীর গুরুত্ব অনস্বীকার্য, কিন্তু দেশের অভ্যন্তরীণ নাগরিক-প্রশ্নে তাহার বিন্দুমাত্র উপস্থিতি না থাকাই বিধেয়। এই বিভাজনটি গণতন্ত্রের স্বার্থে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ, ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা-উত্তর ইতিহাস বিচার করিলে সে বিষয়ে সংশয়ের অবকাশ থাকিবে না। একই ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার দুই দেশে কেন এমন বিপরীতধর্মী খাতে বহিল, সেই প্রশ্নের উত্তরে জওহরলাল নেহরুর নাম আসিবেই। সেনাবাহিনীকে আবশ্যিক ভাবে অসামরিক নেতৃত্বের অধীন থাকিতে হইবে, নেহরুর রাষ্ট্রকল্পনায় এই কথাটি ছিল অনড়। এবং, সেনাবাহিনীর অনধিকারচর্চাকে তিনি কখনও প্রশ্রয় দেন নাই। একদা সেনাপ্রধান ফিল্ডমার্শাল কারিয়াপ্পা দেশের অর্থনীতি পরিচালনায় সরকারের অদক্ষতার মৃদু সমালোচনা করিয়াছিলেন। নেহরু পত্রপাঠ তাঁহাকে জানান, যে বিষয় তাঁহার এক্তিয়ারভুক্ত নহে, সে বিষয়ে মুখ খুলিবার প্রয়োজন তাঁহার নাই। নিয়ন্ত্রণটি কেন জরুরি, ১৯৫৮ সালে তাহা পাকিস্তানের গণতন্ত্রও টের পাইয়াছিল। সে বৎসরই সে দেশে প্রথম সামরিক অভ্যুত্থান হয়। তাহার পর পাকিস্তানে গণতন্ত্র আর কখনও প্রকৃত সুযোগ পায় নাই। ভারত যাহাতে পাকিস্তান না হইয়া যায়, তাহার জন্যই সেনাবাহিনীকে নিজের জায়গায় থাকিতে বাধ্য করা প্রয়োজন— এই কথাটি জওহরলাল নেহরু জানিতেন।
নরেন্দ্র মোদী তাহা জানেন কি? জানিলে, সামরিক বাহিনীর তিন প্রধানকে সঙ্গে লইয়া চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ বিপিন রাওয়ত কেন করোনা বিষয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করিবেন, প্রধানমন্ত্রী নিজেকে সেই প্রশ্ন করিতেন। তাহা না করিয়া বরং রবিবারের পুষ্পবৃষ্টির পর তিনি টুইট করিয়া প্রতিরক্ষাবাহিনীর সৌজন্যপ্রকাশের প্রশংসা করিলেন। দেশের অভ্যন্তরীণ বিপর্যয় মোকাবিলার কাজে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করা হইয়াই থাকে, তাহাতে আপত্তিকর কিছু নাই। বর্তমান পরিস্থিতিতেও তাহা করা যাইত, এখনও যায়। আপত্তি সেনাবাহিনীর ব্যবহার লইয়া নহে, আপত্তি তাহার ক্ষেত্র লইয়া। সেনার ভূমিকা আদৌ থাকিবে কি না, থাকিলেও কী হইবে, তাহা স্থির করিবার অধিকার সেনাপ্রধানের নহে, চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ নামক নবজাত পদটির অধিকারীরও নহে। তাহা অসামরিক সিদ্ধান্ত, সরকারের সিদ্ধান্ত। রাওয়ত এইখানেই এক্তিয়ারের বাহিরে গিয়াছেন।
বিগত ছয় বৎসরে নরেন্দ্র মোদীর সরকার যে ভাবে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করিয়াছে, তাহাতে এখন এই আপত্তির প্রত্যাশা নিতান্ত অর্থহীন। বিপিন রাওয়তই সিএএ-বিরোধী আন্দোলনসহ এমন একাধিক প্রসঙ্গে মুখ খুলিয়াছেন, নৈতিকতার বিচারে যাহা তাঁহার এক্তিয়ারের সম্পূর্ণ বাহিরে, রাজনৈতিক নেতৃবর্গ আপত্তি করেন নাই। আবার, সেনাবাহিনীকেই দেশের সর্বাপেক্ষা সম্মাননীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে প্রতিষ্ঠা করিবার একটি রাজনৈতিক বিপণনযজ্ঞও অবিরত চলিয়াছে। আশঙ্কা হয়— সেনাবাহিনীর প্রতি নাগরিকের যে স্বাভাবিক সম্ভ্রম আছে, নরেন্দ্র মোদী সুকৌশলে তাহাকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করিতে চাহিয়াছেন। এই অপব্যবহারের রাজনৈতিক লাভ স্পষ্ট। কিন্তু দেশের লোকসান বিপুল। সেনাবাহিনীকে অ-সামরিক, বিশেষত রাজনৈতিক পরিসরে সরব ও সক্রিয় করিবার প্রবণতা শেষ অবধি ভারতীয় গণতন্ত্রের শিকড়ে কুঠারাঘাত করিতে পারে।
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)