আশা ছাড়া কী-ই বা করার আছে এখন? অবশ্যই কর্মহীন ভাগ্যের হাতে সমর্পিত আশাবাদ নয়, প্রতিরোধ ও অদম্য ইচ্ছাশক্তির লড়াই-এর আশাবাদ। মনে পড়ছে ১৯২৩ সালে প্রকাশিত রুশ অভিযাত্রী ভ্লাদিমির আরসেনিয়েভের লেখা স্মৃতিকথা থেকে ১৯৭৫ সালে ‘ডেরসু উজালা’ ফিল্ম তৈরি করেছিলেন আকিরা কুরোসাওয়া (সঙ্গে স্থিরচিত্র)। তাঁদের অভিযাত্রী দলের কাজ ছিল ভবিষ্যৎ নগরায়ণের জন্য নতুন নতুন দুর্গম বনভূমি ও সাইবেরিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলের খবর সংগ্রহ করে আনা। সেখানেই একাকী বৃদ্ধ বনজীবী ডেরসুর সঙ্গে রুশ অভিযাত্রীর সাক্ষাৎ। বরফের গর্তে পড়ে যাওয়ার ঘোর বিপদ থেকে অভিযাত্রীকে বাঁচায় ডেরসু। ভয়ঙ্কর বরফ-ঝড়ে হাতের কাছে পাওয়া ঘাসপাতা দিয়ে মাথা গোঁজার নিরাপদ আশ্রয় বানাতে শেখায়।
নির্মম কঠোর প্রকৃতির বিরুদ্ধে নিরস্ত্র মানুষের কাণ্ডজ্ঞানের প্রয়োগে সে ছিল এক অদম্য বাঁচার লড়াই। প্রকৃতিকে ধ্বংস করে বা তাকে পর্যুদস্ত করে নয়, নিজেকে যথাসম্ভব রক্ষা করাই ছিল ডেরসুর শিক্ষা। প্রকৃতির সংহারমূর্তির উল্টো দিকে মানুষের ছোট ছোট পদক্ষেপ গ্রহণ করে টিকে থাকার এই গল্পে দুই অসমবয়সি ও অসম শ্রেণির মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধুত্ব শ্রদ্ধা গড়ে ওঠার কাহিনিও ছিল।
ওই জঙ্গল, বরফ-প্রান্তরের প্রতিটি বিপদের সম্ভাবনা ও সম্ভাব্য আশ্রয়ের কথা ওই স্থানীয় জনজাতির মানুষটির নখদর্পণে। দেখেছিলাম সেই চলচ্চিত্রে, নাগরিক ‘অভিযাত্রী’ এবং গ্রামীণ স্বশিক্ষিত মানুষটির মধ্যে কত অনতিক্রম্য দূরত্ব তৈরি করেছে মানবসভ্যতা!
আজ আর এক বার নিজেদের চার পাশে সেই দূরত্বের ঘেরাটোপ। নিম্নবিত্ত সাধারণ ভারতবাসীর প্রতি ‘আমরা’ আজ শ্রদ্ধা সহানুভূতি হারিয়ে উলঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছি। পদব্রজে যাঁরা হাজার মাইল অতিক্রম করছেন, ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আমরা তাঁদের জন্য হাততালি দিচ্ছি, মধ্যিখানে ‘নো ম্যানস্ ল্যান্ড’। তাঁরা বলতেই পারেন, অসুখটা আপনারা এনেছেন, আমরা না। তাই লকডাউন আমরা না মানলে, তাতে যদি আপনাদের ক্ষতি হয়, তাতে আমাদের কী? আমরা তো দু’দিকেই মরে আছি!
প্রতিটি মানুষ একটি গল্প। প্রতিটি গল্প জুড়ে তৈরি হয় মানববন্ধন। যেমন আমরা পড়েছিলাম কিউবার অবরোধের সময় বাড়ির বারান্দায় মাটি ফেলে সবজি ফলানোর প্রতিরোধ। শুনেছিলাম ভিয়েতনামেও। বিখ্যাত ভিয়েতনাম ট্রেল-এর পাশ ধরে হাইওয়ে দিয়ে যাচ্ছিলাম এক সমুদ্রবন্দরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ ছাত্র বলছিলেন, কুখ্যাত আমেরিকান ওয়ারে (‘ভিয়েতনাম ওয়ার’ বলেন না ওঁরা, কারণ ভিয়েতনামের মানুষেরা তো মোটেই যুদ্ধ করতে চাননি!) নাকি প্রাথমিক স্তরের ড্রোন আবিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, যা মানুষের শরীর খুঁজে আঘাত করতে পারে। গ্রামের মানুষেরা গাছে গাছে দলে দলে মুরগি শুয়োর কুকুর— যা যা খান— তার চামড়ায় মনুষ্য বর্জ্য ভরে টাঙিয়ে দিয়েছিলেন, যাতে ড্রোন তাদের মানুষ ভেবে আঘাত করতে করতে যায়! এই ছিল বিরাট শক্তির বিরুদ্ধে সামান্যের প্রতিরোধ।
মাইল মাইল ফসল নষ্ট করা হয়েছিল আকাশ থেকে ‘এজেন্ট অরেঞ্জ’ ছিটিয়ে, তবুও দমানো যায়নি তাঁদের। বৃক্ষ কেটে নিয়ে গিয়েছিল জাপানিরা। বাইরে থেকে বৃক্ষ এনে বিশেষ পদ্ধতিতে লাগিয়েছিলেন ভিয়েতনামের মানুষেরা। এমন হাজার দেশের হাজার প্রতিরোধের গল্পে ভরে আছে আমাদের স্মৃতি। জানি, জারি আছে মানবতা প্রতিষ্ঠার লড়াই।
তেমনই, আজ আমাদের এত বড় একটা দেশের নানা ধরনের মানুষ, যত দূর পারছেন, লকডাউন সহ্য করছেন। বেশির ভাগ খেতে-পাওয়া কর্মী মানুষ সাবধানবাণী গ্রাহ্য করে বাইরে বেরোচ্ছেন না। নিরুপায় মানুষের কথা আলাদা। কোথাও কোথাও শুনছি স্থানীয় ভাবে সমাধানের চেষ্টা চলছে। ডুয়ার্সের একটি চা বাগানে স্লিপারে গড়িয়ে চাল-ডালের রেশন দেওয়া হচ্ছে। যিনি দিচ্ছেন, তিনি গ্লাভস ও মাস্ক পরে আছেন। স্লিপারের নীচে গোল করে দেওয়া নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে রেশন তুলে নিচ্ছেন মানুষ। এর বেশি এঁদের পক্ষে সম্ভব নয়, আশাও করা যায় না। অনুমতি নিয়েই শিফট কমিয়ে চা-বাগানে স্প্রে দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। শিফট কমানোতে অবশ্যই সকলে একসঙ্গে কাজ পাচ্ছেন না। তা নিয়ে তাঁদের আপত্তি নেই। অসুবিধে সত্ত্বেও কোনও দলই বিরুদ্ধ মত পোষণ করেননি। দূরে দূরে দাঁড়িয়ে নিয়ম মেনে কাজ করছেন শ্রমিকরা। প্রিন্ট মিডিয়া থেকে শুরু করে, সরকারি-বেসরকারি সব তরফের প্রচারে কাজ দিয়েছে, সকলে যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। ভারতীয় মাল পরিবহণকারী রেল কোনও নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠানের কাছে মাল পরিবহণের আবেদন গ্রহণের বিজ্ঞাপন দিয়েছে।
এ সবই হল আশার গল্প। আমাদের আঁকড়ে ধরার খড়কুটো। সব যদি পুরোপুরি কার্যকর নাও হয়, কিছু তো কাজ হবে। হাল ছাড়তে বাধা তো দিতে পারে এই গল্পগুলি!
অতি দ্রুত পাল্টে যাওয়া পৃথিবীতে আমাদের আবার নতুন করে অনেক কিছু ভাবতে হবে। সবটাই যখন আপাতত অনিশ্চিতের উপর দাঁড়িয়ে, তখন খুব ছোট ছোট সদর্থক ভাবনা থেকে আশার রসদ নিতে ইচ্ছে করে। ছোট বলে গল্পগুলি তুচ্ছ নয়!
ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।