corona virus

কোয়রান্টিন ছাড়া এই মহামারি থেকে বাঁচা সম্ভব হবে না

কোয়রান্টিনে বা বাড়িতে বন্দি থাকাকে আমরা বেঁচে থাকার একটি অঙ্গ হিসাবেই আপাতত গ্রহণ করি। নিজেদের সুপ্ত কর্মদক্ষতা ও ইচ্ছেগুলোকে একটু ঝালিয়ে নিই। পরিবার ও প্রিয়জনদের সান্নিধ্য উপভোগ করি।

Advertisement

মিমি সরকার

শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০২০ ০২:০৭
Share:

যেন তৃতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়েছে সারা বিশ্ব জুড়ে। আর লড়াইটা শুরু হয়েছে এক অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে সমগ্র বিশ্ববাসীর। দেশ-কাল-ধর্মের বেড়াজাল তুচ্ছ করে আজ মানুষ লড়ছে অদৃশ্য শত্রু করোনার বিরুদ্ধে। এই লড়াইটা জেতার জন্য আমাদের সামনে কোনও প্রতিষেধক নেই, নেই কোনও ওষুধ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতিমধ্যেই করোনাভাইরাসকে বিশ্ব মহামারি ঘোষণা করেছেন। তাঁরা কোভিড ১৯ ভাইরাসকে রোখার বেশ কিছু নির্দেশাবলিও জারি করেছেন বিশ্বজুড়ে। প্রতিটি দেশই সর্বতো ভাবে চেষ্টা করছে তার জনগণকে সর্বোচ্চ সুরক্ষা প্রদান করতে। উন্নত থেকে তৃতীয় বিশ্ব— প্রায় প্রতিটি দেশ লকডাউন ও কোয়রান্টিন অর্থাৎ ব্যক্তি-সংসর্গ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পথে যেতে বাধ্য হয়েছে বেঁচে থাকার তাগিদে।

Advertisement

করোনার বিরুদ্ধে প্রাথমিক ব্যবস্থা হিসাবে প্রায় সব দেশই এক বাক্যে কোয়রান্টিন ব্যবস্থাকে মান্যতা দিয়েছে। কারণ, এই ব্যবস্থাই বিশ্ববাসীকে মহামারির হাত থেকে বাঁচানোর আপাতত একমাত্র উপায়। পৃথিবী ইতিপূর্বে যে সমস্ত মহামারি তাণ্ডব প্রত্যক্ষ করেছে, তার ইতিহাস লক্ষ করলে দেখা যাবে, যেখানে মানুষ মরণরোগের ছোঁয়াচ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন, সেখানে মানুষ নিজেদের রক্ষা করতে সফল হয়েছেন।

প্রাক্‌-সামাজিক ব্যবস্থায় মানুষ ছোট ছোট গোত্রে বিভক্ত হয়ে বাস করত। ফলে, রোগ-জীবাণু গোত্রের বাইরে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা খুব কম ছিল। কৃষিজীবন শুরু করার পর মানুষ একীভূত সমাজব্যবস্থার জন্ম দেয়। নগর সভ্যতা গড়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গে সংক্রামক রোগগুলি মারাত্মক আকার নিতে থাকে। শিল্পবিপ্লবের সময় গ্রাম থেকে উঠে আসা কর্মপ্রার্থী মানুষ শহরের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গাদাগাদি করে বসবাস করত, এদের বন্যপ্রাণীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠ।
বর্তমানে করোনাভাইরাসের উৎসস্থল চিনের উহান শহরের অবস্থাও ঠিক এই রকম। এই ধরনের জীবনব্যবস্থা প্রাণী থেকে মানুষের সংক্রমণ ঘটায়, যেমনটি চিনে ঘটেছে।

Advertisement

পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম মহামারি জাস্টিনি=য়ান প্লেগ, বাইজানটিয়াম সাম্রাজ্যে ইঁদুর থেকে মাছির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। আটশো বছর পর তা আবার ফিরে আসে ব্ল্যাকডেথ নাম নিয়ে। এই মহামারি কুড়ি কোটি মানুষের জীবন কেড়ে নেয়। করোনাভাইরাসের বর্তমান ভরকেন্দ্র ইতালি সে দিনও ব্লাকডেথ প্লেগের উৎসস্থল ছিল।

১৩৪৭ সালে ইতালীয় নাবিকেরা সিসিলি বন্দরে সারা শরীরে রহস্যজনক ঘা নিয়ে উপস্থিত হতে থাকে। ভেনিস নগরীর বন্দর কর্তৃপক্ষ এই উপসর্গ বিশিষ্ট নাবিকদের সাবধানতা অবলম্বনের জন্য ‘কোয়ারাস্তা’ অর্থাৎ ‘চল্লিশ’ দিনের জন্য গৃহবন্দি করে রাখেন। এই ‘কোয়ারাস্তা’ থেকেই কোয়রান্টিন শব্দটির উৎপত্তি। এই সময় থেকেই কোয়রান্টিন পদ্ধতি মহামারি প্রতিরোধ করার কার্যকরী উপায় হয়ে ওঠে। এক শতাব্দী আগে ১৯১৮-১৯২০ সালে দানব ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ দশ কোটি মানুষের জীবন কেড়ে নেয়। যদিও আপাতদৃষ্টিতে কোভিড-19 রোগের এর মৃত্যুহার স্প্যানিশ ফ্লুয়ের মতো নয়। তবে আত্মসন্তুষ্টির কোনও জায়গা নেই। আবার, একে হালকা ভাবে নেওয়ারও কোনও অবকাশ নেই। কারণ, করোনাভাইরাসের ধ্বংসাত্মক রূপ সম্বন্ধে আমরা কেউ-ই অবগত নই। তাই এর ধ্বংসমাত্রা নির্ধারণ করাও অত্যন্ত দুরূহ। একে রুখে দেওয়ার একমাত্র উপায় বিজ্ঞানসম্মত পন্থা অবলম্বন করা। কোয়রান্টিনই হল শত শত বছরের পরীক্ষিত ও বিজ্ঞানসম্মত উপায়, যার দ্বারা এই মহামারিকে রোখা সম্ভব।

গৃহবন্দি থাকা নিঃসন্দেহে যন্ত্রণাদায়ক। তবে কোয়রান্টিন কিন্তু ‘আইসোলেশন’ নয়। ধরে নিতে পারি, এই মুহূর্তে আমরা সকলেই লকডাউন পরবর্তী কোয়রান্টিনেই আছি। একযোগে কোয়রান্টিনে থাকা ছাড়া বেঁচে থাকার ভাল উপায়ও আমাদের সামনে আর খোলা নেই। আমাদের প্রণম্য স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অনেকেই দীর্ঘ দিন গৃহ অন্তরীণের সাজা ভোগ করেছেন, এই সময়ে আমরা তাঁদের কথা ভাবতে পারি। জগতের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়ার ইংল্যান্ডে সতেরো শতকের গোড়ার দিকে ছড়িয়ে পড়া বুবোনিক প্লেগের প্রকোপ থেকে বাঁচতে কোয়রান্টিনে থাকাকালীন অবস্থায় রচনা করেন ‘কিং লিয়ার’, যা অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটক হিসেবে আজও সারা বিশ্বে সমাদৃত। আরও এক মহান বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ঘটনা ও ‘কোয়রান্টিন কেয়ার’-এর সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। তখন ইংল্যান্ডে দ্বিতীয় বুবোনিক প্লেগ মহামারির আকার ধারণ করেছে। ১৬৬৫ সাল, তরুণ স্যর আইজ্যাক নিউটন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মহামারির কারণে ক্লাস বন্ধ হয়ে গেলে তাঁকে চলে যেতে হল ষাট মাইল দূরে ‘হোম কোয়রান্টিনে’। গৃহবন্দি থাকা অবস্থায় গণিতচর্চা করতে করতেই আবিষ্কৃত হয় মাধ্যাকর্ষণ সূত্রের, আপেল গাছটি তাঁর জানলার বাইরেই ছিল।

তাই কোয়রান্টিনে বা বাড়িতে বন্দি থাকাকে আমরা বেঁচে থাকার একটি অঙ্গ হিসাবেই আপাতত গ্রহণ করি। নিজেদের সুপ্ত কর্মদক্ষতা ও ইচ্ছেগুলোকে একটু ঝালিয়ে নিই। পরিবার ও প্রিয়জনদের সান্নিধ্য উপভোগ করি। দূরত্ব তৈরি হওয়া সম্পর্কগুলো আবার বিনিসুতায় গাঁথামালার মতো হৃদয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হোক। কর্মব্যস্ত মানুষ কয়েক দিনের জন্য ফিরে পাক অবকাশ যাপনের পূর্ণ পরিসর। এ ভাবেই কোয়রান্টিনে থেকে মানুষ নিশ্চিত ভাবেই করোনাকে জয় করবে। আমাদের চেনা পৃথিবী আবার ছন্দে ফিরবে খুব শিগগির।

লেখক সীতানগর হাইস্কুলের শিক্ষক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement