মাননীয়া মহুয়া মৈত্র লোকসভার সদস্য। কৃষ্ণনগরের সাংসদ। বঙ্গদেশের ইতিহাসে এই নগরী তাহার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কারণে স্বীকৃত, সেই শহরের প্রবীণ নাগরিকরা আজও তাহা লইয়া গর্ব করিয়া থাকেন। তাঁহাদের গর্বে দীর্ঘশ্বাসও মিশিয়া থাকে, কারণ, এই রাজ্যের অধিকাংশ ঐতিহ্যের মতোই, কৃষ্ণনগরের গৌরবও তাহার বর্তমান হইতে বহুদূরবর্তী। মৈত্রমহাশয়া সেই দূরত্ব কিছু পরিমাণে লাঘব করিতে পারিতেন। তাঁহার সেই সামর্থ্য ছিল। লোকসভায় এবং অন্যত্র একাধিক বার তিনি আপন বাগ্মিতার প্রমাণ দিয়াছেন। এবং তাঁহার বক্তব্যে তথ্য, যুক্তি এবং তীব্রতার সমাহার ঘটিয়াছে, যে সমাহার এক কালে ভারতীয় সংসদে সুলভ ছিল, এখন বিরল। কিন্তু কেবল সভামঞ্চে ওজস্বী ভাষণ দিলেই কি সংস্কৃতি ও সুরুচির দাবি পূর্ণ হয়? সমাজের বৃহত্তর পরিসরে শালীন আচরণের কোনও প্রয়োজন নাই? জনপ্রতিনিধি হিসাবে সভ্য ও ভদ্র আচরণের দৃষ্টান্ত স্থাপনের কোনও কর্তব্য নাই? মাননীয়া হয়তো তেমনই বিশ্বাস করেন। তিনি হয়তো মনে করেন, কাহারও কথায় বা কাজে বিব্রত বোধ করিলে বা বিপাকে পড়িলে, তাঁহার যাহা ইচ্ছা তাহা বলিবার অধিকার আছে। তাঁহার দুর্ব্যবহারের অভিযোগ নূতন নহে, নদিয়া জেলায় দলের কর্মিসভায় সংবাদমাধ্যম সম্পর্কে অশোভন মন্তব্যটি এই জনপ্রতিনিধির অমাননীয় আচরণের সাম্প্রতিকতম দৃষ্টান্তমাত্র। তিনি এই মন্তব্যেই ক্ষান্ত হন নাই, সমালোচনার সম্মুখীন হইয়া আত্মপক্ষ সমর্থনে বিবিধ কুযুক্তির অবতারণা করিয়া বুঝাইয়া দিয়াছেন— ব্যাধি সারিবার নহে।
মাননীয়া সাংসদ প্রচলিত অর্থে শিক্ষিত। কিন্তু প্রচলিত শিক্ষা অনেক সময়েই স্বাভাবিক ভদ্রতা শিখাইতে পারে না, এমনকি জনসমক্ষে আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রাথমিক শিক্ষাও অনেক ‘শিক্ষিত’ মানুষের অধরা থাকিয়া যায়। বিদ্যা তাঁহাদের বিনয় দেয় না, দেয় বিপুল অহঙ্কার, যে অহঙ্কার মানুষকে মানুষ বলিয়া গণ্য করে না, যে কোনও প্রশ্ন বা প্রতিবাদের জবাবে যাহা দুর্বিনীত অসংযম ও অসহিষ্ণুতায় ফাটিয়া পড়ে। বস্তুত, তথাকথিত শিক্ষা-অশিক্ষা বিচার করিয়া এই ব্যাধির হিসাব মিলিবে না। ব্যাধিটি, এক কথায়, অ-সভ্যতার। অ-সভ্যতাই এই দেশে ফলিত রাজনীতির শিরোভূষণ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। মহুয়া মৈত্র একা নহেন, দেশ জুড়িয়া নানা দলের নানা মাপের রাজনীতিকের আচরণে তাহার নির্লজ্জ প্রদর্শনী দেখিয়া নাগরিকরা ক্লান্ত, অভ্যস্তও। সব রাজ্য এবং সব দলকে এই বিষয়ে একাসনে বসাইলে অবিচার হইবে, কিন্তু আক্ষেপের কথা ইহাই যে, কুকথা এবং দুর্ব্যবহারই ক্রমে নিয়মে পরিণত, ভদ্রতা ও সংযম কার্যত ব্যতিক্রম— সুশীল রাজনীতিক এখন সমাজে ‘অন্য রকম’ বলিয়া গণ্য হন, সুশীল শব্দটিতে অনেক সময় ঈষৎ ব্যঙ্গও নিহিত থাকে। বঙ্গীয় রাজনীতিকদের এক কালের ভদ্রতার সুনাম ছিল। অ-সভ্যতা তখনও সম্পূর্ণ বিরল ছিল না, কিন্তু তাহা ব্যতিক্রম বলিয়াই গণ্য হইত। আজ আর সেই কথা বলিবার কোনও উপায় নাই, বাঙালি অনেক দিনই স্রোতে ভিড়িয়াছে। এবং তাহা লইয়া এই সমাজের বিশেষ লজ্জাবোধও অবশিষ্ট আছে বলিয়া মনে হয় না। সুতরাং, রাজনীতির ভাষা আপন বেগে নর্দমায় প্রবাহিত হইবে। অভিজ্ঞ নাগরিক জানেন, নির্বাচন যত কাছে আসিবে, সেই বেগ তত বাড়িবে— বর্ষাকালে নর্দমা খরস্রোতা হইয়া থাকে।