সম্পাদকীয় ২

বিহু-বিতর্ক

অসমের বাসন্তী উৎসব রঙ্গোলি বা বোহাগ বিহু লইয়া তর্কবিতর্কের ঐতিহ্যটিও এত দিনে বেশ পুরাতন হইল। যে প্রদেশ ভাষা ও প্রাদেশিক সত্তা লইয়া এত রক্তাক্ত সংঘর্ষের মধ্যে দশকের পর দশক কাটাইতেছে, তাহার পক্ষে ইহাই হয়তো স্বাভাবিক।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০০
Share:

অসমের বাসন্তী উৎসব রঙ্গোলি বা বোহাগ বিহু লইয়া তর্কবিতর্কের ঐতিহ্যটিও এত দিনে বেশ পুরাতন হইল। যে প্রদেশ ভাষা ও প্রাদেশিক সত্তা লইয়া এত রক্তাক্ত সংঘর্ষের মধ্যে দশকের পর দশক কাটাইতেছে, তাহার পক্ষে ইহাই হয়তো স্বাভাবিক। এ বৎসরও বিখ্যাত গায়ক জুবিন গর্গের হিন্দি ফিল্মি গান থামাইয়া দিয়া তাঁহাকে যে ভাবে মঞ্চ ছাড়িতে বাধ্য করা হইল, তাহা বিরাট বিতর্কের জন্ম দিয়াছে। বিহু উৎসবে বিহু গান না গাইয়া হিন্দি গান গাওয়া সঙ্গত কি না, তাহা লইয়া গোটা অসম বিক্ষুব্ধ হইয়া পড়িয়াছে। প্রশ্নটি সহজ নহে। স্থানীয় বনাম জাতীয়, আঞ্চলিক সত্তা বনাম রাষ্ট্রীয় সত্তা, এই রাজনীতি বনাম ওই রাজনীতি, বিতর্কের বিচিত্র মাত্রা। তবে প্রথমেই একটি কথা। সব বিতর্কের ঊর্ধ্বেই একটি বৃহত্তর সত্য আছে, যাহার নাম উদারতা, মুক্তি। আঞ্চলিক-ঐতিহ্যধন্য উৎসব বা সংস্কৃতিকে রক্ষা করিতে গিয়া যদি নিষেধাজ্ঞা জারি করিতে হয়, বলপ্রয়োগ করিয়া গায়ককে মঞ্চ হইতে নামাইয়া দিতে হয়, গায়ককে অতঃপর বিশেষ সরকারি নিরাপত্তায় মণ্ডিত করিতে হয়, আলফা উগ্রপন্থীদের ভয়ে তাঁহাকে কাঁটা হইয়া থাকিতে হয়, সে ক্ষেত্রে বলিতে হইবে— যুদ্ধে স্থানীয় পক্ষের পরাজয় ঘটিয়াই গিয়াছে। নৈতিক পরাজয়।

Advertisement

উৎসব উপলক্ষে বহু মানুষ মিলিত হইলে তাঁহারা কী ভাবে উৎসব পালন করিবেন, ইহার কি কোনও নির্দেশিকা থাকিতে পারে? কেহ বলিবেন, আঞ্চলিক উৎসবের সময়ও আঞ্চলিক ভাষার গান না গাহিয়া হিন্দি গানে মজিয়া গেলে অঞ্চলের আর রহিল কী। এমনিতেই তো গোটা বৎসর ভারত জুড়িয়া একটি সংস্কৃতিরই লালনপালন: যাহার নাম বলিউড। বিহু উৎসবের সময়ও তাহাই চলিবে? খুব দরকারি প্রশ্ন। কেবল গান নহে, উৎসবের অন্যান্য আঙ্গিকের মধ্যেও স্থানিক প্রথা ও ভাবনাকে উজ্জীবনের প্রয়াস অসমের কাছ হইতে অন্যান্য অনেক প্রদেশই শিখিতে পারে। বিশেষত সরকারি তরফে হিন্দি চাপাইয়া দিবার সূক্ষ্ম প্রয়াসটি যতই স্থূল ও প্রত্যক্ষ হইতেছে, জনসমাজের প্রতিক্রিয়াও স্বাভাবিক ভাবেই উগ্র হইতেছে— মানিতে হইবে। তবে কিনা, সামাজিক প্রয়াসের মধ্যে আক্রমণ-প্রবণতা বেশি হইয়া উঠিলে মুশকিল। গর্গ কী গান গাহিবেন, তাহা আলোচনা করিয়া লওয়া যাইত, এই অনুষ্ঠানের জন্য বিশেষ ভাবে তিনি বিহু গানেই থাকিতে পারিতেন, বিনোদনের স্বার্থে না হয় একটি-দুইটি ফিল্মি গান গাহিতেন: এই সমস্তই ধৈর্যশীল দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক বিবেচনার বিষয়, মারপিট ভীতিপ্রদর্শনের বিষয় নয়।

এইখানেই আঞ্চলিকতার শক্তি বার বার মার খাইয়া যায়। নিজেদের গায়ে সংকীর্ণতা ও আক্রমণের সিলমোহর লাগাইয়া ফেলিয়া ন্যায্য বিকল্প সংস্কৃতির যে দাবিটি প্রকৃত অর্থেই মূল্যবান, তাহাকে ক্রমশ লঘু ও পশ্চাৎমুখী হিসাবে প্রতিপন্ন করে। বিশেষত নাচগানের মতো স্বতঃস্ফূর্ত গণবিনোদনের বিরুদ্ধতা করিবার পথ যে শেষ পর্যন্ত নিজেদের উদ্দেশ্যটিরই বিপক্ষে চলিয়া যাইতে বাধ্য, এই মূল কথাটি ভুলিলে মুশকিল। বহু দশকের বলিউডি-পনা সত্ত্বেও বিহু সংস্কৃতি কিন্তু আজও যথেষ্ট সম্মান লইয়া বিরাজমান। তাহা লইয়া নিরাপত্তাবোধের এত অভাব কেন? বিকল্প সংস্কৃতিকে আক্রমণ না করিয়া বরং বিকল্পের পাশে নিজের উদার বিস্তার করিলেই মঙ্গল। তাহাতেই কাজের কাজ হইবে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement