বাহ্যিক: সি ভি রামনের শতবর্ষ উদ্যাপনে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু, ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কালটিভেশন অব সায়েন্স, নভেম্বর ১৯৮৮
জ্যোতিবাবু রামরথ আটকাননি, আডবাণীর রামরথ পুরুলিয়া পার হয়ে নির্বিঘ্নে বিহারে চলে গিয়েছিল। তখনও ১৯৯২-এর ৬ ডিসেম্বরের ঘটনা ঘটেনি, কিন্তু দেশ জুড়ে উগ্র হিন্দুেত্বর প্রচার শুরু হয়েছে। আডবাণীর রথ আটকানো হল বিহারে। রথ আটকে নায়ক হয়ে গেলেন লালুপ্রসাদ যাদব।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বিজেপির সাফল্য কম, ৪২ আসনের রাজ্য থেকে বিজেপি কখনও দু’জনের বেশি প্রতিনিধি লোকসভায় পাঠাতে পারেনি। কিন্তু এই মুহূর্তে বিজেপি এ রাজ্যে ক্রমবর্ধমান। পশ্চিমবঙ্গে এই দলের এত বাড়বাড়ন্ত হল কী করে? জ্যোতিবাবু যাদের বলতেন ‘অসভ্য বর্বরদের দল’, সেই দলে বামপন্থীরা ভিড়ছেন কী করে? শুধু ভোটার নয়, নিচুতলার কর্মীরা তলায় তলায় এবং উপর তলার কিছু প্রাক্তন বাম বিধায়ক-সাংসদও পদ্মশিবিরে নাম লিখিয়েছেন। এই ‘দলবদল’কে শুধু ভোটের ভিত্তিতে ভাবলে হবে না। প্রশ্নটা আরও বড়, বামপন্থী মানুষের সমর্থন উগ্র দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদী দল পাচ্ছে কী করে? তবে কি ‘বামপন্থা’র মধ্যেই গলদ ছিল? সেই বামপন্থা যথেষ্ট অসাম্প্রদায়িক, বিজ্ঞানমনস্ক ভাবনার বিকাশ ঘটাতে পারেনি?
৩৪ বছর ক্ষমতায় থেকে সিপিআই(এম) কি তবে শুধু এক নির্বাচন থেকে আর এক নির্বাচনের দিকেই যাত্রা করেছে? উন্নত থেকে উন্নততর সরকারের কথা বলে ভোট আদায় করেছে? মানুষের মধ্যে বস্তুবাদী চেতনা জাগানোর চেষ্টা করেনি?
চেষ্টার প্রমাণ অবশ্য কাগজে-কলমে রয়েছে। ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’র মতো দেশ জুড়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প যখন ছড়িয়ে পড়ছে, ১৯৯২-র ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছে, তখন সাম্প্রদায়িকতা মোকাবিলায় বিজ্ঞানপ্রচারে গুরুত্ব দিতে চেয়েছে সিপিএম। (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২ জানুয়ারি ১৯৯৩) খবরে প্রকাশ: রাজ্য সিপিএম নেতৃত্ব মনে করেন ‘‘সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, ধর্মান্ধতা, বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বিজয়কে স্থায়ী করতে হলে প্রয়োজন জনগণের মধ্যে জীবন সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি গড়ে তোলা।’’ কিন্তু রাজ্যে ক্ষমতায় আসার ১৫-১৬ বছর পরে এই বোধোদয় কেন? তা হলে কি কমরেডের নবযুগ আনা মানে ছিল সরকারের বদল? চিন্তা-চেতনার বদল নয়?
সিপিএম বিজ্ঞান সংগঠন গড়ার দিকে নজর দেয়নি বললে সত্যের অপলাপ হবে। ১৯৮৬-র ২৯ নভেম্বর গড়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ। সংস্থার প্রকাশিত নথিতে বলা হয়েছে, ‘‘সামাজিক দায়বদ্ধতার দৃষ্টিকোণ থেকে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করা, সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা ও যুক্তিবাদী মননশীলতাকে গড়ে তোলা, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে যুক্তিবাদী প্রচার চালানো, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে জনজীবনের মৌলিক সমস্যা সমাধানের কাজে প্রয়োগ করা— পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের জন্মলগ্নে সংগঠকদের কাছে এগুলো ছিল প্রধান বিচার্য বিষয়।’’
কিন্তু সত্যিই কি তাই? সত্যসন্ধানে চোখ বোলানো যাক ইতিহাসে। ‘‘কেবলমাত্র পার্টি সভ্যদের জন্য’’ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী)-র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি ১৯৮৬-র ২০ জুলাই একটি ‘পার্টি চিঠি’ প্রকাশ করে, যার শিরোনাম ছিল ‘বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রচারের গুরুত্ব সম্পর্কে প্রাথমিক আলোচনা’। সেই আলোচনার গোড়াতেই পেশ করা হল ১১ জুলাই ১৯৮৬ তারিখের ‘রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর নোট’। যাতে খোলাখুলি বলা হল ‘‘(আমরা) পশ্চিমবাংলায় বিজ্ঞান আন্দোলন গড়ে তুলতে ইতিপূর্বে বিশেষ কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারিনি। এই আন্দোলনে বর্তমানে বিভিন্ন রাজনৈতিক মনোভাবাপন্নদেরই প্রাধান্য থেকে গেছে। এ কারণেই এই আন্দোলনে আমাদের অনতিবিলম্বে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন বলে রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী মনে করছে।’’ অর্থাৎ রাজ্যে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা বিজ্ঞান আন্দোলনে পার্টির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাই ছিল লক্ষ্য। বলা হল, সারা রাজ্যব্যাপী বিজ্ঞান আন্দোলনকে ‘অভিন্ন স্রোতধারায়’ রূপান্তরের কথা। আর এই লক্ষ্যেই ১৭ অগস্ট সিটু হলে অনুষ্ঠিত হল রাজ্যের বিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত পার্টি সদস্যদের সভা। স্পষ্ট করে এও বলা হল, পার্টির এই কাজে প্রধান সহায় সরকার। পার্টির চিঠিতে লেখা হল, ‘‘পশ্চিমবাংলার বামফ্রন্ট সরকার এই আন্দোলনের সহায়ক হিসাবে ভূমিকা পালনে সক্ষম। বামফ্রন্ট সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করতে, জনগণের দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানের ব্যবহারকে কিছুটা বাস্তবায়িত করতে এবং সর্বোপরি জনগণের মধ্যে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে সক্ষম।’’
এখন, পার্টির নেতৃত্বে (পড়ুন কর্তৃত্বে) সরকারের মুখাপেক্ষী বিজ্ঞান আন্দোলনে বৈজ্ঞানিক চেতনার বিকাশ কতটা হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। তাই বামপন্থী শাসনে কোনও ভাবেই ধর্মান্ধতা আর জাতপাত কমল না। বাড়ল নানান ধরনের ধর্মব্যবসা। কেউ যদি বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পরলোকে বিশ্বাস না রেখে বাবা-মার মৃত্যুর পর শ্রাদ্ধ না করতেন, তবে তাঁর জন্য বরাদ্দ নির্যাতনের খবর কাগজে মিলল, মিলল ডাইনি সন্দেহে হত্যা বা ভিন্ন ধর্মে ও জাতে বিয়ে করার অপরাধে শাস্তি দেওয়ার খবরও। নবযুগ তো এলই না, বরং আরও প্রতিক্রিয়াশীল মানসিকতারই সাক্ষী হলেন রাজ্যের মানুষ। বামপন্থী বিজ্ঞানকর্মীদের লড়াই করার কথা ছিল, কিন্তু দেখা গেল আদতে পার্টি ক্যাডাররাই হয়েছেন বিজ্ঞানকর্মী। তাদের কেউ কেউ দেওয়ালে লিখলেন ‘মার্ক্সবাদ সর্বশক্তিমান কারণ ইহা বিজ্ঞান’ আবার কেউ কেউ কব্জিতে লাল সুতো আর আঙুলে রত্নের আংটি পরে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি গঠনের গুরুত্ব সম্পর্কে বক্তৃতা দিতে লাগলেন।
তন্নিষ্ঠ বিজ্ঞানকর্মী কেউ কেউ যে ছিলেন না তা নয়, শিক্ষক-গবেষকরাও ছিলেন। তবে কালক্রমে পার্টির নিয়ন্ত্রণে তাঁরা প্রান্তিকই হয়ে গেলেন। মৌলালি যুব কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত (১৯৮৬-র ২৯ নভেম্বর) যে বিজ্ঞান কনভেনশনের মধ্য দিয়ে পার্টির বিজ্ঞান সংগঠনের জন্ম তার আহ্বায়ক ‘পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান আন্দোলন প্রস্তুতি কমিটি’র পক্ষে অনেক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদের পাশাপাশি ছিল ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী এবং ‘বিজ্ঞান আন্দোলনের সংগঠক’ পরিচয়ে নিরুপম সেন, শ্রীদীপ ভট্টাচার্য, মানব মুখোপাধ্যায় এবং সুজন চক্রবর্তীর নাম। এঁরা সকলেই পার্টির নেতা এবং ভোটে জেতা বিধায়ক ও কালক্রমে মন্ত্রী অথবা ভোটে হারা পার্টি প্রার্থী। সংস্থা পঞ্জিকরণ নথিতে (২৯ নভেম্বর ১৯৮৭) আবার দেখা যাচ্ছে, প্রতিষ্ঠাতা সদস্যের মধ্যে এক জনের পেশাই ‘বিজ্ঞান আন্দোলন’, যিনি পরবর্তী কালে হাওড়া লোকসভা কেন্দ্রে পার্টির প্রার্থী হয়ে পরাজিত হন। রাজনৈতিক নেতা বিজ্ঞান আন্দোলন করতে পারবেন না, তা নয়। কিন্তু এখানে তাঁদের ঘোষিত পরিচয় এবং পরবর্তী কালে তাঁদের কাজ খুঁটিয়ে দেখলেই আন্দোলনের ফাঁক ও ফাঁকিটা ধরা পড়ে।
এ পর্যন্ত পড়ে কেউ বলতেই পারেন বামপন্থী সরকার বিদায় নেওয়ার পর সরকারনির্ভর পার্টির বিজ্ঞান সংগঠনের দাপট কমাটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু সরকারে থাকার ২৫ বছরে তো মঞ্চের অনেক সম্মেলন হয়েছে। সেই সব সম্মেলনেই বা কতটা মতাদর্শগত লড়াইয়ের জমি তৈরি করা হয়েছিল? ১৯৮৯-তে বিজ্ঞান মঞ্চের প্রথম ও ১৯৯১ সালে দ্বিতীয় রাজ্য সম্মেলনের প্রস্তাব-প্রতিবেদনে চোখ বোলালে দেখা যাবে ১৯৯২-পূর্ববর্তী সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়া বা তার প্রতিরোধের কোনও কথাই সেখানে নেই। দ্বিতীয় রাজ্য সম্মেলনে উপস্থাপিত জেলা কমিটিগুলির বিগত দু’বছরের কর্ম-প্রতিবেদন পড়তে গিয়ে চোখ আটকে যায় নদিয়ার পাতায়, যেখানে লেখা ‘‘এ বছরে রাজ্য কমিটি আমাদের জেলার সদস্য সংগ্রহের কোটা নির্দিষ্ট করেছিলেন ৫০০, আমরা তা অতিক্রম করেছি, সংগৃহীত সদস্য সংখ্যা ৬০৫’’; এই ‘কোটা বাঁধা’ বিজ্ঞান আন্দোলনের পক্ষে কি সম্ভব বস্তুবাদী মতাদর্শগত লড়াই চালানো?
এক অদ্ভুত সন্ধিক্ষণে আজ আমরা দাঁড়িয়ে। এক দিকে বিজ্ঞান মঞ্চের ৩২ বছর পূর্তি হচ্ছে, অন্য দিকে বিজেপির রাজ্য জুড়ে রথযাত্রার পরিকল্পনা। এরই মধ্যে আবার ৬ ডিসেম্বর আসছে, সামনে ২০১৯-এর লোকসভা ভোট। সাম্প্রদায়িক শক্তিকে আটকানোর জন্য ধর্মনিরপেক্ষ জোটগঠনের প্রস্তুতি দেশ জুড়ে। কিন্তু প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতার বোধ জাগাতে পারত যে বিজ্ঞানচেতনা, তার বিকাশ রুদ্ধ। বছরভর উৎসবের সবই ধর্মকেন্দ্রিক। বাংলাদেশের একুশে ফেব্রুয়ারি বা পয়লা বৈশাখের মতো সেকুলার উৎসব আমরা চালু করতেই পারলাম না।
বলা হচ্ছে রামরথ না আটকানোর জন্য জ্যোতিবাবুর দলকে ইতিহাস ক্ষমা করবে না। কিন্তু না, ঠিক আডবাণীর রথ না আটকানোর জন্যে নয়, পশ্চিমবঙ্গের সমাজের মনোরথে সাম্প্রদায়িকতা-জাত-পাত আর অযুক্তি আটকানোর উপযোগী বিজ্ঞানচেতনার বিকাশ না ঘটাতে পারার জন্যই ইতিহাস ক্ষমা করবে না ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকা ‘বামপন্থী’ দলকে।
কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের শিক্ষক