প্রয়োজনীয়: ২০১৬ সালে ইলেকট্রনিক্যালি ট্রান্সমিটেড পোস্টাল ব্যালট বিষয়ক একটি সভা। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
ভারতের সাধারণ নির্বাচনে পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা বহু পুরনো। কিন্তু কিছুকাল আগে পর্যন্ত এই ব্যবস্থা শুধুমাত্র তিন ধরনের সরকারি কর্মীরাই ব্যবহার করতে পারতেন— সেনা, নৌ বা বিমানবাহিনীতে যাঁরা কর্মরত; যাঁরা কেন্দ্রীয় পুলিশবাহিনীতে আছেন, বিদেশে ভারতীয় দূতাবাসে যাঁরা আছেন; কিংবা সেই সমস্ত কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারি কর্মী, যাঁরা নির্বাচনের কাজে যুক্ত থাকার জন্য অন্যত্র ডিউটিতে আছেন ও তাই নিজের বুথে গিয়ে ভোট দিতে পারছেন না। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে ১৮ লক্ষেরও কিছু বেশি সংখ্যক এই ধরনের কর্মী পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দেওয়ার আবেদন করেন। তাঁদের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ প্রকৃতপক্ষে ভোটে অংশগ্রহণ করেন।
কিন্তু এই ব্যবস্থাকে কী ভাবে বৃহত্তর স্বার্থে ব্যবহার করা যায়? লক্ষ লক্ষ ভোটার যাঁরা কর্মসূত্রে বা অন্য কোনও কারণে অন্যত্র থাকার জন্য ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোটদানে অংশ নিতে পারছেন না বা অসুস্থ মানুষ বা বৃদ্ধ ভোটাররা শারীরিক কারণে ভোটবুথে যেতে পারছেন না, তাঁদের সুবিধার্থে এই ব্যবস্থাকে কী ভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে? এই বিষয় নিয়ে অতীতে খুব একটা ভাবনাচিন্তা হয়নি।
পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোটে অংশগ্রহণ করতে হলে এক জন সরকারি কর্মীকে যেখানে তিনি ভোটার হিসেবে নথিভুক্ত সেই কেন্দ্রের রিটার্নিং অফিসারের কাছে নির্দিষ্ট ফর্মের মাধ্যমে আবেদন করতে হয়। ব্যালট ছাপানো হয়ে গেলে বন্ধখামে ডাকযোগে তাঁকে সেটি পাঠানো হয়। ব্যালটটি পেয়ে পছন্দের চিহ্নে ভোট দিয়ে ভোটারকে সেটি আবার বন্ধখামে ডাকযোগে ফেরত পাঠাতে হয় রিটার্নিং অফিসারকে। ব্যালট পাঠাবার এবং ফেরত আনার ডাকমাসুল নির্বাচন কমিশনই বহন করে। যখন আরও লক্ষ লক্ষ চিঠির সঙ্গে এই সমস্ত ব্যালট গন্তব্যে যায়, ডাকব্যবস্থার উপর প্রচণ্ড চাপ পড়ে। রিটার্নিং অফিসার যে পোস্টঅফিসে ছাপানো ব্যালটটি বুক করলেন, সেখান থেকে জেলার সর্টিং সেন্টার হয়ে রাজ্যের সর্টিং সেন্টারে, তার পর ট্রানজ়িট মেল অফিস হয়ে গন্তব্যের সর্টিং হাবে এবং সবার শেষে ডেলিভারি পোস্টঅফিস পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই ব্যালট সংক্রান্ত চিঠির উপরে বিশেষ নজরদারি রাখা হয়, হিসেব রাখা হয়। আবার ভোটদানের পর ব্যালটটি যখন ফেরত যায় তখনও একই রকম নজর রাখতে হয়।
যদিও পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে যা ভোট পড়ে শতাংশের বিচারে সেটা সামান্যই, তবু কালেভদ্রে সেটাই অসামান্য হয়ে ওঠে— যখন লড়াইটা চলে হাড্ডাহাড্ডি। যত দূর মনে পড়ে, ১৯৮৯-এর লোকসভা নির্বাচনে হাওড়া কেন্দ্রে এই পোস্টাল ব্যালটের হিসেবেই তখনকার জাঁদরেল কংগ্রেস প্রার্থী প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি হেরে যান প্রতিদ্বন্দ্বী বামফ্রন্ট প্রার্থীর কাছে।
ডাকযোগে ভোটব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল— ব্যালটটি যেন ঠিক ভোটারের কাছে পৌঁছয় এবং ভোটদানের পরে ব্যালটটি যেন রিটার্নিং অফিসারের কাছে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অর্থাৎ ভোটগণনা শুরুর নিদেনপক্ষে এক ঘণ্টা আগে পৌঁছায়। সাধারণত ডাকবিভাগের যে কর্মীরা পোস্টাল ব্যালট নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের কাজটার গুরুত্ব ও সংবেদনশীলতা সম্বন্ধে যথেষ্ট পরিমাণে ওয়াকিবহাল করা হয়।
বছর চারেক আগে ভারতের নির্বাচন কমিশন এক নতুন ব্যবস্থা শুরু করে, যাকে বলা হল ইলেকট্রনিক্যালি ট্রান্সমিটেড পোস্টাল ব্যালট (ইটিপিবি)। নতুন ব্যবস্থায় ব্যালটটি প্রকৃত ভোটারের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব থেকে ডাকবিভাগ মুক্তি পায়। ছাপানো ব্যালটের বদলে সেটির একটি প্রতিলিপি ইন্টারনেটের মাধ্যমে ভোটারকে পাঠানো হয়। ব্যালটের প্রিন্ট নিয়ে ভোটার তাঁর পছন্দমতো ভোট দেবেন। ভোটদানের পর মুখবন্ধ খামে ব্যালটটি স্পিডপোস্টে রিটার্নিং অফিসারকে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি ভোটারেরই দায়িত্ব। ফলে, নতুন ব্যবস্থায় ব্যালটটি স্পিডপোস্টে ফেরত আসার বিষয়টি নিয়ে ডাকবিভাগের মাথাব্যথা অনেকটা কমে যায়। অতিরিক্ত খরচও নির্বাচন কমিশনই বহন করছে।
মুশকিল হল, ইটিপিবি ব্যবস্থায় ধরেই নেওয়া হচ্ছে যে একটি কম্পিউটার, প্রিন্টার এবং ইন্টারনেট ব্যবস্থা ভোটারের নাগালে আছে। কিন্তু সব ভোটারের তো তা থাকে না। যত ক্ষণ বিষয়টা সরকারি কর্মীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, কিছু বলার ছিল না। কিন্তু ইটিপিবি ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর কমিশন ভাবতে শুরু করল, ৮০ বছরের বেশি বয়স্ক ভোটারদের কি পোস্টাল ব্যালটের আওতায় আনা যাবে? সেই ভাবনা থেকে, কয়েক মাস আগে ঝাড়খণ্ড বিধানসভা নির্বাচনে সাতটি কেন্দ্রে একটি ‘পাইলট’ (প্রথম বার হাতেকলমে করে দেখা) করা হয়। ৬৫ বছরের উপর সমস্ত ভোটারকে এবং অসুস্থ ভোটারদের পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দিতে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায় কি না, এখন অতিমারির সময়ে সেই বিষয়ে নির্বাচন কমিশন ভাবনাচিন্তা করছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এই প্রস্তাবে বিভিন্ন মতামত জানিয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবটি নিশ্চয়ই অভিনব। তবে প্রস্তাবটি আরও বৈপ্লবিক হত যদি পরিযায়ী শ্রমিক এবং অন্যত্র থাকার কারণে যাঁরা ভোটে অংশ নিতে পারছেন না তাঁদেরকেও এই প্রস্তাবের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা যেত। তবে, প্রস্তাবটিতে এখনও পরিষ্কার হয়নি যে ভোটারের কাছে ব্যালটটি পৌঁছবে কী ভাবে, বৈদ্যুতিন মাধ্যমে না স্পিড পোস্টে? বৈদ্যুতিন মাধ্যমে পাঠাতে পারলে ঝামেলা কম। কিন্তু কী ভাবে নিশ্চিত করা যাবে যে এক জন বয়স্ক ভোটার কম্পিউটার, প্রিন্টার, ইন্টারনেট ব্যবহারে স্বচ্ছন্দ হবেন? মনে হয়, অন্তত শুরুতে কমিশন একটা ‘হাইব্রিড’ ব্যবস্থার কথা ভাবতে পারে। ভোটারকে নিজেকেই বাছার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে তিনি কী ভাবে ব্যালটটি পেতে চান, ইন্টারনেটে না ডাকযোগে।
যদি বহু সংখ্যক ভোটার ডাকযোগে ব্যালট পেতে চান, তবে পোস্টঅফিসের উপর একটা গুরুদায়িত্ব চাপবে। প্রতিযোগিতামূলক রাজনৈতিক পরিবেশে নিরস্ত্র পোস্টম্যান যখন চিঠি বিলি করতে বেরোবেন তখন কেউ যে তাঁর থেকে ব্যালট কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে না— তারই বা নিশ্চয়তা কোথায়? নামকরা ক্লাবগুলির নির্বাচনে দুই গোষ্ঠীর হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের সময় ডাককর্মীদের কিন্তু এই ধরনের ঘটনার মোকাবিলা প্রায়ই করতে হয়। তাই ঠিক ভাবে ব্যালট-বিলি নিশ্চিত করতে, ডাকবিভাগকে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে এগোতে হবে।
আরও মনে রাখতে হবে যে, বাড়িতে বসে ভোট দিলেই যে বয়স্ক ভোটার স্বাধীন ভাবে ভোট দিতে পারবেন, তাঁর উপর যে পরিবার বা পাড়ার বিরুদ্ধ মতাদর্শের ছেলেছোকরারা মানসিক বা শারীরিক চাপ সৃষ্টি করবে না— তারও কিন্তু নিশ্চয়তা নেই। তাই পোস্টাল ব্যালট ব্যবস্থাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত ভীতির পরিবেশ মুক্ত করার দিকটাতেও মন দিতে হবে।