দাবি

নাগরিকত্ব বস্তুটি কোনও ‘সরকার’-এর ছেলেখেলার বিষয় নহে। ইহা ‘রাষ্ট্র’-এর বিষয়। রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে প্রধান সম্পর্ক: নাগরিকত্ব। তাহা কাহার প্রাপ্য, কাহার নহে, ইহা কোনও দলীয় সরকারের একার বিবেচনাধীন হইতে পারে না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:০৪
Share:

অন্তত জনান্তিকে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কি স্বীকার করিতেছেন যে, দেশে সরকার ও সমাজের মধ্যে যে যুদ্ধপরিস্থিতির উদ্ভব হইয়াছে, তাহা একেবারেই অবাঞ্ছিত এবং অকারণ ছিল? কেবল বড় শহরগুলিতে বিক্ষোভের বান বহিতেছে না, গ্রাম-মফস্‌সল-জনপদগুলিও কাঁপিতেছে আতঙ্ক ও আশঙ্কার শিহরনে। কেন্দ্রীয় সরকারের এনআরসি, এনপিআর ও নূতন নাগরিকত্ব আইনের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য লইয়া জাতি-ধর্ম-গোষ্ঠী নির্বিশেষে মানুষ উদ্বিগ্ন ও আতঙ্কিত। মন্ত্রীরা এখন যতই হাঁকিয়া বলুন, ভয় নাই— নিশ্চিন্ত হওয়া মুশকিল, কেননা তাঁহারাই বহু যত্নে এই অ-স্বাভাবিক পরিস্থিতি নির্মাণ করিয়াছেন। ভয়ঙ্কর-কে লেলাইয়া দিয়া ‘ভয় নাই’ বাণী প্রচার নিতান্ত নির্মম। বিষয়টি ক্রমশ ভয়ঙ্করতর হইয়া উঠিতেছে— সত্যভাষণে মন্ত্রীদের অবিশ্বাস্য অপারগতায়। মোদী ও শাহের ক্রমাগত বিপরীত কথা প্রচার, এক বার এক রকম বলিয়া পরে আর এক রকম বলা ইত্যাদিকে মজার বিষয় ভাবিলে ভুল হইবে, সংবাদপত্রের চিত্তাকর্ষক শিরোনাম এবং দৃশ্যমাধ্যমের বাদানুবাদের বিষয় ভাবিলে চলিবে না, ইহা সংসদীয় গণতন্ত্রের চূড়ান্ত অপমান, দেশের প্রশাসনের দুই শীর্ষপদের অধিকারীদের নজিরবিহীন দায়িত্বজ্ঞানহীনতা। বিপুল ভোটে দেশের নাগরিক যাঁহাদের জয়ী করিয়াছেন, সরকারে আসীন হইয়া তাঁহারা মানুষকে এই ভাবে নাগরিকত্ব হারাইবার ভয়ের মুখে ঠেলিয়া দিয়া দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করিয়া বীভৎস মজা দেখিতেছেন— ইহার তুল্য ভয়ানক মুহূর্ত ভারতীয় গণতন্ত্রে আর কখনও আসিয়াছে কি?

Advertisement

একটি গোড়ার কথা বুঝিতে হইবে। নাগরিকত্ব বস্তুটি কোনও ‘সরকার’-এর ছেলেখেলার বিষয় নহে। ইহা ‘রাষ্ট্র’-এর বিষয়। রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে প্রধান সম্পর্ক: নাগরিকত্ব। তাহা কাহার প্রাপ্য, কাহার নহে, ইহা কোনও দলীয় সরকারের একার বিবেচনাধীন হইতে পারে না। ইহার জন্য ন্যূনতম শর্ত: সর্বদলের আলোচনাভিত্তিক সিদ্ধান্ত, কেবল সংখ্যাগুরু ভোটের জোরে নাগরিকত্বের শর্ত পাল্টাইয়া ফেলিয়া দেশের চরিত্র রাতারাতি পরিবর্তন করা যায় না। নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ এই গণতন্ত্রের প্রতিনিধিমাত্র, রাজা নহেন। গণতন্ত্রের প্রতি সম্মান দেখাইতে তাঁহারা বাধ্য। এনআরসি-এনপিআর লইয়া একাদিক্রমে ভুল/মিথ্যা/পরস্পরবিরোধী কথা ছাড়িয়া তাঁহারা নাগরিক সমাজের সম্মুখে প্রতিটির যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দিতে বাধ্য।

নাগরিক সমাজের দাবি— এনআরসি হইবে কি হইবে না, কবে হইবে, কোথায় হইবে, ইত্যাদি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রথমে ‘ঐকমত্য’-এ আসুন। তাহার পর সেই ঐকমত্য সাধারণ্যের সামনে দৃষ্টিগোচর করুন। যে পথটি প্রধানমন্ত্রী সর্বদা পরিহার করিয়া চলিতে অভ্যস্ত, গণতন্ত্রের সেই অন্যতম প্রয়োজনীয় পথ— সাংবাদিক সম্মেলনে ব্যাখ্যা করিয়া বলুন, কেন এনপিআর এখনই শুরু করা দরকার। কেন এনপিআর-এর সঙ্গে এনআরসি-র সম্বন্ধ নাই বলিয়া তাঁহারা দাবি করিতেছেন। যদি সম্বন্ধ না-ই থাকে, তাহা হইলে অসমে এনআরসি হইয়া গিয়াছে বলিয়া সেখানে এনপিআর হইতেছে না কেন। যদি সম্বন্ধ না-ই থাকে, এনপিআর-এ সর্বৈব নূতন প্রশ্নাবলি (যেমন বাবা-মায়ের জন্মস্থান) সংযোজিত হইতেছে কেন। যদি কেহ এনপিআর-এ এই সব তথ্য দানে অপারগ হন, তাঁহাদের কী পরিণতি হইবে। নাগরিকত্বের হিসাবনিকাশ রাফাল যুদ্ধবিমানের মতো জাতীয় নিরাপত্তার গোপন বিষয় নহে। ইহার সম্পর্কে অবহিত হওয়া সমাজের অধিকার। স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল ভাবে সমাজকে অবহিত করা সরকারেরই দায় ও দায়িত্ব। এখনও অবধি নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহের ভাব, দেশের মানুষের কাজ নাগরিক হিসাবে নিজেকে প্রমাণ করা। সম্পূর্ণ উল্টাটিই সত্য। রাষ্ট্রের কাজ দেশের মানুষকে নাগরিক হিসাবে প্রতিষ্ঠা দেওয়া। পথান্তর নাই।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement