ছবি: সংগৃহীত
সময়টা একেবারেই সুখের নয়। আগুন শেষ পর্যন্ত আটকানো গেল না। নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ হওয়ার দিন থেকেই অসম, ত্রিপুরা, মেঘালয়ে তার লেলিহান এবং প্রাণঘাতী প্রকাশ আমরা দেখেছি। দিল্লি-সহ দেশের অন্য অনেক রাজ্যেও পরিস্থিতি খুব ভাল নয়। উন্মত্ত উত্তেজনার আঁচ থেকে বাদ নেই বাংলা। ঘটছে অবাঞ্ছিত ঘটনা। সব মিলিয়ে যেন এক ত্রাসের দেশ!
সংখ্যার জোর যখন বিশ্বাসের গলা টিপে ধরতে চায়, তখন প্রতিবাদ স্বাভাবিক। হাঁড়িকাঠে ওঠার আগে নিরীহ পশুটিও চিৎকার করে ‘বাঁচতে’ চায়। এটা জীবধর্ম। তবু এই অস্থির সময়ে সবাইকেই মনে রাখতে হবে, প্রতিবাদ সঙ্গত হলেও তা যেন সংযত থাকে। হিংসা-হানাহানি সমাধানের কোনও পথ নয়। তাতে সাধারণ মানুষের দুর্গতি বেড়ে যাওয়া এবং মুষ্টিমেয় লোকের স্বার্থসিদ্ধি ছাড়া আর কিছু হয় না।
যাঁরা হিংসায় জড়াচ্ছেন, তাঁরা কোথাও না কোথাও, কোনও না কোনও ফাঁদে পড়ছেন। এই পথ পরিহার করা তাই আমাদের সকলের প্রথম কর্তব্য। অগ্নিতে ঘৃতাহুতি না দিয়ে দলমত নির্বিশেষে সকলের উচিত হাতে হাত মিলিয়ে আগুনের শেষ ফুলকিটুকুও নিবিয়ে দেওয়া। যাঁরা দেশের দশের নেতা বলে পরিচিত, এখন তাঁদের অনেক বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। বুঝতে এবং বোঝাতে হবে, প্রতিবাদ মানে উন্মত্ত তাণ্ডব নয়। অশান্তির আগুনে কেউ বাঁচে না। যাঁরা তা বুঝবেন না, ইতিহাস এবং মনুষ্যত্ব তাঁদের ক্ষমা করবে না।
এটা ঠিক, সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগে সংসদে বিল পাশ করানো, আর অগণিত সাধারণ মানুষের বিশ্বাস অর্জন করার মধ্যে যে কত ফারাক, অমিত শাহেরা সেটা এখন হাড়ে হাড়ে বুঝছেন। অন্যান্য রাজ্যের কথা না-হয় বাদই দিলাম। অসম, ত্রিপুরা তো অমিত শাহদের দখলে। বিপুল জনসমর্থনে সেখানে বিজেপির সরকার চলছে। ধরে নেওয়া সঙ্গত, সেখানকার অধিকাংশ মানুষ বিজেপির মত ও পথে আস্থাশীল। অথচ ক্ষোভের আগুন প্রথম জ্বলেছে ওই দুই রাজ্যে।
উত্তর-পূর্বের এই ক্রোধের পিছনে আর্থ-সামাজিক কারণ খোঁজা হচ্ছে। সেই যুক্তি উড়িয়ে না দিলেও তার বিশ্লেষণ এ ক্ষেত্রে খুব জরুরি নয়। আরও বড় সত্য হল, বিজেপিকে যাঁরা ভোট দিয়ে সেখানে ক্ষমতায় বসিয়েছেন, তাঁরাই নিজেদের সমর্থনপুষ্ট দলের কথা বিশ্বাস করতে পারছেন না। নয়া আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ তাই উন্মত্ত চেহারা নিয়েছে।
এই কাজ করতে গেলে আগুন ছড়াবে, সেটা না-বোঝার কোনও কারণ ছিল না। অসমে নাগরিক পঞ্জি অর্থাৎ এনআরসি চালু করে বিজেপি নিজেদের হাত-মুখ কী ভাবে পুড়িয়েছে, তা-ও বলার অপেক্ষা রাখে না। বস্তুত অসমের নাগরিক পঞ্জিতে নাম বাদ যাওয়া ১৯ লক্ষ বাসিন্দার মধ্যে ১২ লক্ষই যে হিন্দু, সেটা দেখে অমিত শাহদের হিসেব তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল। তাই পুজোর আগে কলকাতায় সভা করতে এসে তিনি দলকে জানিয়ে যান, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন চালু হওয়ার আগে নাগরিক পঞ্জি হবে না।
সংবিধানের মর্মবাণীকে কার্যত নস্যাৎ করে এবং ধর্মীয় বিভাজনকে ঘুরপথে সিলমোহর দিয়ে সংশোধিত নাগরিকত্ব বিল এখন আইনে পরিণত। ফলে নাগরিক পঞ্জি তৈরি করার রাস্তাও অবারিত। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চেয়ারে বসে শাহ ইতিমধ্যেই হুমকি দিয়েছেন, গোটা দেশে এ বার এনআরসি শুরু হবে।
তখনই বলা হয়েছিল, এটা আসলে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা। অসমের অভিজ্ঞতার পরে অন্য এক চতুর খেলা। আসলে এনআরসি-তে যাঁদের নাম বাদ পড়বে, তাঁদের মধ্যে মূলত হিন্দুদের ভারতের নাগরিক করে নেওয়ার টোপ গেলানোর জন্য আগে নাগরিকত্ব আইনের কিছু সংস্থান বদল করার প্রয়োজন ছিল। প্রথম ধাপে শাহ সেটাই করলেন। এনআরসি নিয়ে চাপের জায়গাটি কিন্তু থেকে গিয়েছে। যার পরিধি ও শঙ্কা দুই-ই অনেক বড়।
প্রকৃতপক্ষে ভারতে বংশানুক্রমে বসবাসকারীদের ক্ষেত্রে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন আপাত ভাবে খুব একটা কাজে লাগার কথা নয়। কারণ বলা হয়েছে, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে সংখ্যালঘু অর্থাৎ অ-মুসলিমরা এ দেশে চলে এলে ‘শরণার্থী’ হিসেবে পাঁচ বছর থাকার পরে যাতে খুব ‘সহজ’-এ নাগরিকত্ব পেতে পারেন, সেই লক্ষ্যে ওই আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হল।
একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, কিছু দিন আগে পর্যন্ত এই রকম আবেদনকারীর মোট সংখ্যা ছিল বড়জোর ৩২ হাজার। এখন হয়তো তা কিছুটা বাড়বে। তবে নাগরিক পঞ্জির হুমকি মাথায় নিয়ে এখানে দীর্ঘ দিন ধরে বসবাস করা মানুষদের অবস্থান আরও কঠিন। সেখানে হিন্দু-মুসলিম-জনজাতি কোনও ভেদ নেই। আর সেখানেই নয়া নাগরিকত্ব আইনের ভূমিকা যথেষ্ট ‘তাৎপর্যপূর্ণ’।
কেন, তা বুঝতে হবে। এনআরসি-র পরিণাম কত নিদারুণ হতে পারে, কী ভাবে লক্ষ লক্ষ বাসিন্দার নাম নাগরিকের তালিকা থেকে বাদ পড়ে যায়, অসম তার টাটকা প্রমাণ। রাষ্ট্র মনে করেছে, সেখানকার ১৯ লক্ষ বসবাসকারীর কাছে নিজেদের ভারতীয় হিসেবে ‘প্রমাণ’ করার মতো যথেষ্ট নথিপত্র নেই। নিজের দেশে বাবা-ঠাকুরদা-চোদ্দোপুরুষের ‘অস্তিত্ব’-এর কাগজপত্র তাঁরা দাখিল করতে পারেননি। তাই জাতীয় নাগরিক পঞ্জিতে তাঁদের নাম উঠল না! সোজা কথায়, যাঁদের নথিপত্র সরকারের কাছে ‘গ্রহণযোগ্য’ বা ‘যথেষ্ট’ বলে মনে হবে না, তাঁরা বংশপরম্পরায় এ দেশে বসবাসকারী হলেও পার পাবেন না। অসম সেটা বুঝিয়ে দিয়েছে।
বাংলা, ত্রিপুরা, পঞ্জাব বা অন্যত্র একই ঘটনা ঘটবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? আজ আপনি-আমি নাগরিক। কাল চাহিদামতো নথি দিতে না পারলে এনআরসি-র খাতায় আপনার-আমার নাম ওঠাও অনিশ্চিত। অ-মুসলিম হলে যদিও বা একটু ‘সম্ভাবনা’ থাকবে, মুসলিমদের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা আরও বেশি।
তা হলে উপায়? অমিত শাহদের নিদান হল, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন। সেখানে নাম লিখিয়ে আবার ভারতের নাগরিক হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। কবে সেই আবেদন করা যাবে, তার জন্য পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে কি না, বা কত দ্রুত আবেদনের নিষ্পত্তি হবে— সে সব এখনও পরিষ্কার নয়। আবেদন মঞ্জুর না হলে হাল ত্রিশঙ্কু!
সমস্যা আছে আরও। মধ্যবর্তী সময়ে আবেদনকারীর অবস্থান কী হবে? তাঁরা কি তখন ‘শরণার্থী’ হয়ে আশ্রয় শিবিরে চলে যাবেন? যাঁরা চাকরি-ব্যবসা করে, বাড়ি, গাড়ি সম্পত্তি করে স্থিতু হয়েছেন, তাঁদের সব কিছু কি তখন অটুট থাকবে? না থাকলে তো তাঁরা আবার ছিন্নমূল! আর থাকলে সেটাই বা ‘আইনসিদ্ধ’ হবে কোন যুক্তিতে? এ সবের উত্তরও অস্পষ্ট। উদাহরণ সেই অসম।
আসলে এই ধূসরতার জায়গাটি আমার, আপনার, ঠাকুরনগরের মতুয়ার বা মেটিয়াবুরুজের ওস্তাগরের মতো ধর্মমত নির্বিশেষে সকলের ক্ষেত্রেই সমান বাস্তব এবং সমান শঙ্কার। তাই যাঁরা মনে করছেন, নয়া আইন তাঁদের পায়ের তলার জমি শক্ত করল, নাগরিক পঞ্জিতে নাম না উঠলেও তাঁরা রাতারাতি সংশোধিত আইনের বলে ফের ‘ভারতের নাগরিক’ হয়ে যাবেন, তাঁরা হয়তো সবটা ঠিক ভাবছেন না। এমন নির্দিষ্ট আশ্বাসের বাণী নয়া আইনেও নেই।
পরিস্থিতি কোথায় গড়াবে, এখনই তা বলা শক্ত। তবে শুভবুদ্ধি সমাচ্ছন্ন হলে বিপদ বাড়ে। সেটা আমরা কখনও চাইব না।