ছবি এফপি।
চিন প্রথম সুযোগেই কাজ সারিল। করোনা-উত্তর পর্বে আইনসভার অধিবেশন বসিতেই হংকং-এর উপর অস্ত্রোপচার শুরু হইল। বিগত বৎসরটি হংকংবাসীর গণতন্ত্রকামী আন্দোলনের জন্য স্মরণীয় ছিল। প্রত্যর্পণ আইন লইয়া নাস্তানাবুদ হইবার ক্ষত শুকায় নাই বেজিং-এরও, অতএব পুনরাবৃত্তি ঠেকাইতেই চিকিৎসার বন্দোবস্ত। ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসে প্রস্তাবিত নূতন জাতীয় নিরাপত্তা আইন অনুসারে, হংকং কর্তৃক চিনা সরকারের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা বা রাষ্ট্রদ্রোহ, কিংবা বেজিং-এর অধীনতা হইতে বিচ্ছিন্নতা ও তাহাকে বিপর্যস্ত করিবার চেষ্টাও নিষিদ্ধ হইবে। ইহা নাকি ‘এক দেশ দুই ব্যবস্থা’ শাসনতন্ত্রটিকে আরও পোক্ত করিবে। অন্যায় ঢাকিতে আরও অন্যায়ের প্রয়োজন হয়। আইনটি একদেশদর্শী তো বটেই, উহা প্রস্তুত করিতে শাসনতন্ত্রের দ্বিতীয় ব্যবস্থা অর্থাৎ হংকং আইনসভার মতগ্রহণেরও প্রয়োজনীয়তা বোধ করে নাই বেজিং। করোনাভাইরাসের কারণে যে গতিময় আন্দোলনটি সাময়িক স্তব্ধ হইয়াছিল, তাহার গতি যাহাতে আর সচল হইতে না পারে, সেই কারণে কি তড়িঘড়ি আইনের বন্ধন?
এই প্রচেষ্টা অবশ্য নূতন নহে। ১৯৯৭ সালে ব্রিটেন যখন হংকং-কে গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের হস্তে তুলিয়া দিল, এবং তাহা চিনের বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চলে পরিণত হইল, তাহার পর পঞ্চাশ বৎসর কতগুলি নীতি মান্য করিবার কথা ছিল বেজিং-এর। ১৯৮৪ সালে চিন-ব্রিটিশ যৌথ ঘোষণায় বেজিং অঙ্গীকার করিয়াছিল যে হংকং-এর উদারনীতি, নিজস্ব শাসন ব্যবস্থা, স্বাধীন বিচারবিভাগ এবং ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তাহারা সম্মান জানাইবে। অন্তত পঞ্চাশ বৎসর। কিন্তু গণতন্ত্রই যাহাদের নিকট আদরণীয় নহে, জনতার মুক্ত গতিবিধি তাহাদের অস্বস্তি ঘটাইবে বইকি। অতএব ছয় বৎসরের মাথায়, ২০০৩ সালে জাতীয় নিরাপত্তা আইনের রূপরেখা বানাইয়া ফেলিয়াছিল চিন। নগরবাসীর আন্দোলনের চাপে সেই যাত্রায় রণে ভঙ্গ দিতে হয়। ২০১৪ সালে চিন গণতান্ত্রিক সংস্কার খারিজ করিয়া দেওয়ায় দ্বিতীয় দফার সংঘাতটি বাধে। বস্তুত, যত বারই হংকং-এর সংবিধানস্বরূপ ‘বেসিক ল’ বা মূল আইনটি উৎসাদন করিবার চেষ্টা হইয়াছে, তত বারই তাহা রক্ষায় পথে নামিয়াছেন হংকংবাসী।
২০১৯ সালের প্রত্যর্পণ আইন বিরোধী আন্দোলন সেই সংগ্রামেরই চূড়ান্ত রূপটি প্রত্যক্ষ করিয়াছিল। চিন সরকারও বসিয়া থাকে নাই, রাষ্ট্রযন্ত্রের পেশিশক্তি যত দূর প্রদর্শন করা সম্ভব তাহার কিছু অধিকই করিয়াছিল। কিন্তু শেষাবধি অক্লান্ত গণআন্দোলন দেখিয়া বেজিং বুঝিয়াছে, স্থানীয় সমর্থন আদায় করিবার ভাবনা অলীক। সুতরাং মুষ্টিযোগ। কোভিড-১৯’এর অবসরকে বহু স্বৈরাচারী শাসকই রাজনীতিতে কাজে লাগাইতেছেন, কিন্তু অভূতপূর্ব স্বাস্থ্য সঙ্কটের ভিতরেই এই রূপ আইনানুগ বজ্র আঁটুনির ব্যবস্থা অনুমান করা কঠিন ছিল। বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আঁচ পাইয়া আইনটি লইয়া চিন দেশে দেশে দৌত্যও শুরু করিয়াছে, তালিকায় আছে ভারতও। কিন্তু আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া অনুকূল হইবার আশা কম। ইতিমধ্যে মার্কিন বিদেশসচিব প্রস্তাবটিকে ‘বিধ্বংসী’ বলিয়াছেন। হংকং-এর আইনসভায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করিয়াছেন গণতন্ত্রপন্থী সদস্যরা। ইতিমধ্যেই বিদ্রোহদীপ্ত জনতা হংকং-এ শান্ত থাকিবে কি না, ইহাই এখন প্রশ্ন।