জলই জীবন। তাই জল আনতে গিয়ে প্রায় জীবন দিয়ে ফেলে মেয়েরা। যেমন বাঁকুড়ার অঙ্গনওয়াড়ি শিক্ষিকা নিভা দত্ত। মাত্র বিয়াল্লিশ বছরে বুক ধড়ফ়়ড়। কী করে? ‘‘পাঁচ বছর ধরে প্রতিদিন ১১২ জনের রান্নার জল তুলেছি টিউবওয়েলের পাম্প করে করে,’’ বললেন নিভা। জয়পুর ব্লকে তাঁর ময়নাপুর ৩ অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে টিনের শেডের তলায় বিশাল মাটির উনুন। বাসনকোসনও মাপসই। শ্বাসকষ্ট সামলে প্রায় যজ্ঞিবাড়ির রান্না সামলেছেন নিভা। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ বিনায়ক দেব গ্রামেরই স্কুলে হার্ট ক্যাম্পে নিভাকে পরীক্ষা করে বললেন, রক্তাল্পতার উপর ক্রমাগত চাপ পড়ায় হৃদযন্ত্র বড় হয়ে যেতে পারে। টিউবওয়েল টেপা বারণ। ‘‘কিন্তু তা হলে রান্না হবে কী করে?’’ প্রশ্ন নিভার।
তবু নিভার কপাল ভাল, সামনেই টিউবওয়েল। বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার ২৫-৩০ শতাংশ কেন্দ্রে ভরসা কুয়ো কিংবা নদী। নদী মানে নদীখাত। এক ফুট গর্ত করে রাখলে চুঁইয়ে জল পড়ে। বালতি করে তাই তুলে আনতে হয়। জনাপঞ্চাশ শিশুর খিচুড়ি রান্না, হাত ধোয়া, সব্জি ধোয়া, বাসন ধোয়ার জন্য জল লাগে ধরুন গিয়ে ৫০ লিটার। জল নীচে চলে গেলে ২৫-৩০ বার টিপতে হবে টিপকলের হ্যান্ডেল। কুয়ো বা নদী থেকে জল তুলে আনা তার চাইতেও কষ্টের কাজ।
এই নাকি মেয়েদের ‘এমপাওয়ারমেন্ট’। খাতায়-কলমে যা খুদে পড়ুয়াদের ছড়া শেখানো, পাঁচ-সাতটা রেজিস্টার রাখার কাজ, কিংবা রান্না করে খাওয়ানোর কাজ, হাতে-কলমে তাই হয়ে দাঁড়ায় বালতি বালতি জল টানার কাজ। জল বওয়া, কাঠকুটোর উনুন ধরাতে গিয়ে চোখের জল ফেলা, কোনওটা লেখা নেই অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী-সহায়িকা, কিংবা মিড ডে মিল কর্মীদের ‘জব ডেসক্রিপশন’-এ। এ সব মিনিমাগনার শ্রম। এক সরকারি কর্তা বললেন, ‘‘জল আনা, জ্বালানি জোগানোয় স্থানীয় বাসিন্দাদের যোগদানের কথা বলা আছে বটে, কিন্তু সে নেহাত কথার কথা।’’
জল তোলার মজুরি, প্রশ্নটা শুনলেই কপালে চোখ তোলেন কর্তারা। ‘রান্না করতে মাসে ২৮৫০ টাকা তো দেওয়া হচ্ছে। ওটুকু কমিউনিটি সার্ভিস।’ এই কর্তারাই অবশ্য ট্যুরে গেলে প্রতিটি মিনারেল জলের বোতলের বিল করতে ভোলেন না। জনসেবার দায়টা কেবল নীরক্ত, অপুষ্ট, গরিব মেয়েদের ঘাড়েই চাপে। গ্রীষ্মের সকাল-দুপুরে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের খিচুড়ি কিংবা ইস্কুলের মিড ডে মিল রান্না যদি দেখা যায়, তা হলে স্পষ্ট হয় কেন এ কাজ মেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট। নিতান্ত গরিব মেয়ে ছাড়া কেউ ওই টাকায় এই কাজ করবে না। যত প্রত্যন্ত গ্রাম, যত তীব্র অভাব হোক না কেন, উপযুক্ত মজুরি না পেলে পুরুষরা বরং পেটে কিল মেরে বিড়ি ফুঁকে দিন কাটাবে, কিন্তু বিনা পয়সায় দিনে ৫০ লিটার জল তুলবে না, নামমাত্র মজুরিতে ৫০ জনকে খাওয়াবে না।
পুরুষরা যা করতে কোনও দিন রাজি হবে না, কী করে মেয়েরা তাতে রাজি হয়? কারণ, বাড়িতে তারা এতেই অভ্যস্ত। এ রাজ্যের ১ কোটি ৩৭ লক্ষ গ্রামীণ গেরস্তালির কেবল ৪১ লক্ষে বাড়ির ভিতরে পানীয় জলের উৎস আছে। সেখানে ৪৩ লক্ষ গেরস্তালির থেকে জলের উৎস হাফ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে। একটা হিসেব বলছে, গোটা ভারতে কেবল পানীয় জল আনতে মেয়েরা ১৫ কোটি শ্রমদিবস খরচ করে। তার ন্যূনতম মজুরি দিতে চাইলে সরকারকে দিতে হত বছরে হাজার কোটি টাকা। শুধু তো জল নয়, আগুনও জোটে মেয়েদের মিনিমাগনা শ্রমে। বিশ্ব ব্যাঙ্ক বলছে, কেবল কাঠকুটো জোগাড়, ঘুঁটে-গুল তৈরির মজুরি দিতে চাইলে বার করতে হবে ছশো কোটি টাকা। মেয়েদের কুড়নো কাঠ জ্বালিয়ে এ দেশে প্রতি বছর মোট যত শক্তি উৎপন্ন হয়, তা গোটা বছরে আমদানি-করা তেল থেকে উৎপন্ন শক্তির চাইতেও বেশি।
কিন্তু হাজার কোটি কিংবা ছশো কোটির হিসেবও পুরো হিসেব নয়। সে তো জল আনা, কাঠ আনার ন্যূনতম মজুরি। ঘরে ঘরে কলের জল, রান্নার গ্যাস পৌঁছে দেওয়ার খরচ যত পড়বে, মেয়েদের শ্রমের মূল্য আসলে ততই। কারণ তারা খাটছে বলেই ওই খরচটা করতে হচ্ছে না তার দেশের সরকারকে। যে গরিব মেয়েদের ভর্তুকি দেওয়ার কথা সরকারের, কাজের বেলায় তারাই বছরের পর বছর হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে সরকারকে।
মেয়েদের শ্রমের উপর এই যে দখলদারি, তা আসলে মেয়েদের দেহের উপর দখলদারির উল্টো পিঠ। এ দেশে একটি মেয়ে যে বাড়ি ধোয়া-মোছা করে, সে বাড়ি তার নয়। যে খেতে কাজ করে, সে জমি তার নয়। সে সুতো রং করে কিন্তু তাঁত তার নয়, রস জ্বাল দেয় কিন্তু খেজুর গাছের মালিকানা অন্যের। স্বত্ব নেই বলে সে মালিক নয়, পুঁজি নেই বলে ব্যবসায়ী নয়, মজুরি মেলে না বলে শ্রমিকও নয়। সে স্রেফ মেয়েছেলে। গরিব হোক আর মধ্যবিত্ত, মেয়েরা যে বাড়ির ভিতরে স্বামী-শাশুড়ির হাতে মার খায়, বাড়ির বাইরে রেপ হয়ে যায়, তার কারণ কেবল মাতলামি, ক্রোধ, যৌনতাড়না নয়। তার কারণ, মেয়েদের ভয় দেখিয়ে, লজ্জা দিয়ে, এবং তাতেও না কুলোলে মারধর করে ধরে রাখতে না পারলে স্রেফ পেটচুক্তিতে খাটিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়।
আফ্রিকানদের দিয়ে বিনা পয়সায় তুলো খেতের কাজ করাতে কত না চাবুক, বেড়ি, পাহারার ব্যবস্থা করতে হয়েছিল আমেরিকানদের। মেয়েদের নিয়ন্ত্রণ সহজ, স্বামী-সন্তানদের দেখালেই হল। তুমি জল না নিয়ে এলে তারা জল পাবে না, তুমি কাঠ না আনলে রান্না হবে না। নিজের শ্রমের মূল্য চাওয়ার অর্থ, তুমি মা নও। বউ নও। মানুষ নও। এমন ইমোশনাল অত্যাচারে কাজ না হলে শুদ্ধ, দেশি মারধর আছেই।
একশো দিনের কাজের মজুর নিজের ঝুড়ি-কোদাল আনলেও সরকার তার ভাড়া-বাবদ একটা বাড়তি টাকা বরাদ্দ করেছে, কিন্তু মেয়েদের জল আনার বাড়তি শ্রমের জন্য এক পয়সাও বরাদ্দ নেই। গেরস্তালির বাইরে মেয়েদের এনে চাকরি দিয়েও সরকার যখন জল আনার শ্রমটা ‘ফ্রি সার্ভিস’ বলে ধরছে, যখন বলছে, ‘যা পাচ্ছ ওই ঢের,’ তখন পরিবারের কর্তার মতো কাজ করছে সরকার। কম মজুরিতে, বিনা মজুরিতে মেয়েদের কাজ করানো চলে, এই অন্যায় ধারণাকে ন্যায্যতা দিচ্ছে সরকারও। অথচ কী সংসারে, কী সমাজে, এই ধারণাটাই মেয়েদের জায়গাটা নির্দিষ্ট করে পুরুষের নীচে। যার কাজের মূল্য দিতে হবে না, সেই মানুষটাকে মূল্য দেবার কী আছে? তখন মনে হতে থাকে, মেয়েদের দু’চারটে চড়-চাপড় দেওয়া পুরুষের পক্ষে স্বাভাবিক। এমনকী, প্রয়োজনও মনে হতে থাকে। মেয়েদের ন্যায্য মজুরি না দিয়ে ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট কিংবা মহিলা থানার জন্য টাকা ঢালা মানে গোড়া কেটে আগায় জল দেওয়া।
আর, কেবল মারধর, ধর্ষণ, খুনই তো হিংসা নয়। প্রবল গ্রীষ্মে তেষ্টার জল আনতে তিন কিলোমিটার হাঁটতে বাধ্য করাও হিংসা।
এই হিংসা মেয়েদের জন্যই নির্দিষ্ট। তা থেকে বাঁচার অক্ষমতাকে পরিবার যদি বলে মেয়েদের ‘সম্মান’, তো রাষ্ট্র বলে মেয়েদের ‘সক্ষমতা।’
এ দেশটা আজও দেশের মেয়েদের নয়।