নিরুদ্দেশ। মাঝসমুদ্রে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। ছবি: রয়টার্স।
সবাই তাঁকে ঘাড় উঁচু করেই দেখেছি। তিনি জননেত্রী, তিনি মানবাধিকার কর্মী, তিনি গণতন্ত্রের জন্য লাগাতার আন্দোলন চালাতে পারেন, তিনি ফৌজি সরকারের রোষ ফুৎকারে উড়িয়ে দেন, তিনি গৃহবন্দি হয়ে থাকতে পারেন দীর্ঘ সময়। ১৯৯১ সালে শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করে নোবেল কমিটি তাঁকে উপাধি দিয়েছিল ‘ক্ষমতাহীনের ক্ষমতা’। কিন্তু তাঁরই দেশের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর মানুষের ওপর যখন সংখ্যাগুরুরা, এমনকী সরকারও অত্যাচার চালায়, তখন তাঁদের হয়ে লড়া তো দূরস্থান, আউং সান সু চি এক বারও গলা তোলেন না, কথা বলেন না তাঁদের জন্য, তাঁদের মানবাধিকারের জন্য।
প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, বাকিরা এখনও রয়েছেন পশ্চিম মায়ানমারে রাখিন প্রদেশের একটা অংশে, সেটাকে এক রকম জেল বলা যেতে পারে। সেখানে না আছে কাজ, না আছে খাবার, না ডাক্তার, না ওষুধ, না শিক্ষা। এবং কার্যত এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, রোহিঙ্গাদের কাছে যাতে এ সব সুবিধে কিছুতেই না পৌঁছয়। গত কুড়ি বছর ধরে একটি আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কাজ করছিল, তাদেরও এক রকম তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপুঞ্জ বলছে, ‘মায়ানমার-এর রোহিঙ্গা জনজাতি সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে নিপীড়িত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলির অন্যতম।’ তিন-চার পুরুষ ধরে বসবাস করা সত্ত্বেও মায়ানমার এদের নিজের লোক মনে করেনি। ১৯৪৮ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী উ নু’র সময় নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল বটে, কিন্তু ১৯৬২ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পরে আবার তা কেড়ে নেওয়া হয়, প্রশাসনের নানাবিধ নিষেধ তাদের ওপর চেপে বসে। ১৯৭৮ সালে বড় ধরনের আক্রমণ শুরু করে সেনাবাহিনী। অগণিত মানুষ প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যায় বাংলাদেশে, ঠাঁই পায় রিফিউজি ক্যাম্পে। ২০১১ সালে বাংলাদেশ ও মায়ানমারের মধ্যে উদ্বাস্তু প্রত্যর্পণের উদ্যোগে রোহিঙ্গাদের স্থান হয়নি। তারা দেশহীন, রাষ্ট্রহীন।
এ কাহিনি চলাকালীনই কিন্তু সু চি’র আন্দোলনের ইতিহাস রচনার শুরু। আশির দশকে তিনি সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। মায়ানমারে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর এই সংগ্রাম বৃহত্তর মানবাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে গভীর ভাবে সম্পর্কিত। সেই 'অপরাধ'-এই তিনি দুই দশকের বেশি সময় ধরে সামরিক সরকারের রোষে গৃহবন্দি থেকেছেন। এই লাগাতার লড়াই তাঁকে এনে দিয়েছে নোবেল শান্তি পুরস্কার, আরও নানান সম্মান। অথচ মানবাধিকারের এই প্রতিমূর্তি স্বদেশের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর সংখ্যাগুরুদের অমানবিক অত্যাচার ও নিপীড়নে চুপ। কেন? ২০১২ সালে ভারতীয় এক টিভি চ্যানেলে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘হিংসা দু-তরফেই হয়েছে। আমি কোনও পক্ষ অবলম্বন করতে চাই না, দুই তরফের সমন্বয় তৈরি করতে চাই।’ এবং সেই বছরই নভেম্বরে সিডনিতে একটি বক্তৃতায় সু চি বলেন, ‘মানুষের দরকার সুরক্ষা, দোষারোপ নয়। আমি কাউকে দোষারোপ করছি না, কারণ কেবল দোষারোপ করলে কোনও ভাল ফল প্রত্যাশা করা যায় না।’ এই নিতান্ত দুর্বল সাফাই ক্রমশ প্রশ্ন তুলেছে, সমালোচনা ডেকে এনেছে। ডেসমন্ড টুটু বা দলাই লামা’র মতো মানুষরা বার বার তাঁকে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু তিনি নীরব।
সু চির সমস্যা কোথায়, তা ব্যাখ্যা করেছেন অন্য এক মানবাধিকার কর্মী, যিনি নিজেও সামরিক সরকারের রোষে চার বছর গৃহবন্দি ছিলেন। তিনি বলেছেন, সু চি খুব সুবিধেজনক অবস্থায় নেই। তিনি গত কয়েক বছর ধরে সামরিক বাহিনী অনুমোদিত সরকারের সঙ্গে এক ধরনের বোঝাপড়ায় এসে দেশের পরিস্থিতি বদলাতে চাইছেন। সেই পরিবর্তন কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য, মায়ানমারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যই। সরকার সু চি’কে সহজে জমি ছাড়তে রাজি নয়। ফলে তাঁকে খুব সুচিন্তিত উপায়ে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হচ্ছে। তাঁর এই সমস্যাটা বুঝতে হবে।
সু চি নিজেও মনে করেন তিনি সিস্টেমের মধ্যে থাকলে তবেই সাধারণ মানুষের জীবনে বৃহত্তর পরিবর্তন আনতে পারবেন। আর সিস্টেমের ভিতরে ঢুকতে হলে তাঁকে এবং তাঁর পার্টিকে ক্ষমতা পেতে হবে। সেই ক্ষমতা পাওয়ার জন্যেই এ বছরের শেষে নির্ধারিত নির্বাচনটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আইনের প্যাঁচে সু চি নিজে যদি প্রেসিডেন্ট হতে না-ও পারেন, তাঁর দলের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা প্রবল। সেই জন্যই সু চি হয়তো এই সময় সংখ্যাগুরুদের ক্ষোভের কারণ হতে চাইছেন না। ঘটনা হল, কেবল রাখিন প্রদেশেই নয়, সারা মায়ানমার জুড়েই রোহিঙ্গা-বিদ্বেষ প্রবল। এই পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকারের হয়ে কথা বললে হয়তো সু চি সংখ্যাগুরুর আস্থা হারাবেন। রোহিঙ্গাদের ‘ক্ষুদ্র’ স্বার্থ উপেক্ষা করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বৃহত্তর স্বার্থের প্রতি তাঁকে মনোনিবেশ করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী তাঁর কর্মসূচি স্থির করতে হবে। অর্থাত্, রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে সু চি’র এই নীরবতা রাজনৈতিক। সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সু চি বরাবর বলে এসেছেন তিনি এক জন রাজনীতিবিদ। ২০১২ সালে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, তিনি সারা জীবন রাজনীতিই করতে চেয়েছেন।
কিন্তু মানবিকতার বৃহত্তর নীতি? যিনি বিশ্বে মানবাধিকার আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে পরিচিত, তিনি কেন নিজের দেশের অত্যাচারিতের কথা বলতে গিয়ে বাছবিচার করবেন? মানবাধিকারের আগে রাখবেন জাতীয়তাবাদকে? তা হলে তাঁর শান্তি পুরস্কারের সম্মান কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? গাঁধীজি একাধিক বার নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েও পাননি। বলা হয়েছিল, তিনি অসাধারণ শান্তিকামী এক জন মানুষ ঠিকই, কিন্তু তিনি ভারতীয় জাতীয়তাবাদী, সেই পরিচয়টা তাঁর বিশ্বমানবতাকে ছাপিয়ে গেছে, তাই এই পুরস্কার তাঁকে দেওয়া ঠিক হবে না। সু চি তো কেবল জাতীয়তাবাদেই সীমাবদ্ধ নেই, সংকীর্ণ গোষ্ঠীবাদে নিজেকে খণ্ডিত করেছেন!
তিনি হয়তো বলবেন, মায়ানমারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে তাঁর পার্টিকে ক্ষমতা পেতে হবে। তিনি যদি এখন রোহিঙ্গাদের দাবি, তাঁদের বিরুদ্ধে অত্যাচার, তাঁদের অধিকার নিয়ে কথা বলেন, তবে রোহিঙ্গাদের হিতে বিপরীত হতে পারে। সু চি’র ওপর রোষের খেসারত দিতে হতে পারে বেচারা রোহিঙ্গাদের। তার চেয়ে বরং নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করা যাক। সু চি’র দল জিতে গেলে তখন রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে, তাদের অবস্থার উন্নতি হবে, এমনটাই আভাস দিচ্ছে তাঁর দল।
রাজনীতির নেতা এমন ভাবে ভাবতেই পারেন, কিন্তু জননেতা? সু চি হলেন এমন এক জন নেতা, যাঁর অনুগামীরা ছড়িয়ে রয়েছেন কেবল তাঁর নিজের দেশে নয়, সারা পৃথিবীতে, তাঁর কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে নতুন দিগন্ত খুলে দেওয়ার চেষ্টা করছেন নিপীড়িত মানুষদের জন্য। দেশের অগণিত মানুষ তাঁকে দেখেছেন তাঁদের মসিহা হিসেবে। তিনি তো চেষ্টা করতে পারতেন তাঁর অনুগামীদের মানবতার পথে ধাবিত করতে, তাঁদের মধ্যে এমন একটা মানসিকতা জাগ্রত করতে, যা রোহিঙ্গাদেরও অত্যাচার, বঞ্চনার হাত থেকে মুক্তি দিতে পারত। মায়ানমারের মূল জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে পারত। তাদেরও হক থাকত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য বা বাসস্থানে। সেই বৃহত্তর মানবতার সাধনার মধ্যে দিয়ে তাঁর অনুগামী মায়ানমারের সংখ্যাগুরুদের নিজেদেরও একটা উত্তরণ ঘটত। সেটাই হত যথার্থ নেতার কাজ। কিন্তু সু চি সে পথে না গিয়ে সংখ্যাগুরু গোষ্ঠীর মতকে অনুসরণ করলেন। তিনি তাদের চটাতে চাইলেন না। যাঁকে সবার অনুসরণ করার কথা ছিল, সেই সু চি অনুসরণ করলেন সংখ্যাগরিষ্ঠতার ক্ষমতাকে। আর তাই তাঁর ক্ষুদ্রতর স্বার্থের জন্য, মানবতার বৃহত্তর স্বার্থ মার খেল।