ছবি: সংগৃহীত
যেন একই প্রহসনের পুনরভিনয়, মাত্র সাত মাসের ব্যবধানে। কর্মসংস্থানের অবস্থা নিয়ে জাতীয় নমুনা সমীক্ষার পরিসংখ্যানে সে বার যখন দেখা গেল বেকারত্বের হার যে উচ্চতায় ঠেকেছে তা গত পঁয়তাল্লিশ বছরের মধ্যে ছুঁতে পারেনি, সরকার বাহাদুর প্রায় হীরকরাজার স্টাইলেই জানিয়ে দিলেন— এ তথ্যে জনগণের কাজ নেই। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে জনমানসে এমন তথ্যের প্রভাব কেমন হবে না হবে, সে বিবেচনার তখন সময় কোথায়? ক্ষমতা যখন আমার হাতে, পরিসংখ্যানও আমার। আমিই ঠিক করে দেব জনগণ কোন তথ্য জানবে কোনটি জানবে না।
কিন্তু বিধি সামান্য হলেও বাম। সে তথ্য সে বার ‘লিক’ হয়ে গেল। যাঁরা জানার তাঁরা জানলেন, কাগজে লেখালিখিও হল। শতাধিক অর্থনীতিবিদ উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতিও দিলেন। মজার ব্যাপার, সে বিবৃতির পাল্টা এক বিবৃতি এল একদল হিসেবশাস্ত্রীর দিক থেকে (অর্থনীতিবিদদের থেকে নয়)। তাঁরা বললেন, আমরা সরকারের পাশে আছি। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলন করে জানিয়েও দিলেন যে এই দ্বিতীয় দলই ঠিক বলছেন, আর প্রথম দল সরকারের ‘স্বভাব সমালোচক’। বোঝা গেল না, এই কাজের জন্যে মন্ত্রিমশাইকে হিসেবশাস্ত্রীদের ওপরই নির্ভর করতে হল কেন। বলিউড অভিনেতাদের দিয়েও বলাতে পারতেন, কারণ অমর্ত্য সেন অর্থশাস্ত্রী হয়েও যদি ভারতীয় গণতন্ত্র নিয়ে বিবৃতি দিতে পারেন, অভিনেতারা জাতীয় নমুনা সমীক্ষার পদ্ধতিগত ত্রুটি নিয়ে কেন বলতে পারবেন না? তবে যেটা বোঝা গেল, যে কোনও তর্কই শেষ করতে হবে সরকারের পাশে থাকার, ‘দেশদ্রোহী’দের দেশছাড়া করার অঙ্গীকারে।
তার পর বিপুল জনাদেশ নিয়ে এনডিএ আবার সরকারে এল। ভেবেছিলাম, আশেপাশে যে হেতু আর একটা তেমন নির্বাচন নেই, এ বার বোধ হয় প্রতাপান্বিত সরকার বাহাদুর জাতীয় নমুনা সমীক্ষায় কী তথ্য এল, তা নিয়ে আর মাথা ঘামাবেন না। কিন্তু মাথা ঘামান বা না ঘামান, অন্তিম পরিণতি প্রায় একই— পাভলভীয় প্রতিক্রিয়া। জনগণের অত তথ্যে কাজ কী বাপু? আর সে তথ্য যদি আমার সাফল্যের বেলুনের হাওয়া বার করে দিতে পারে, তা দেশবিরোধী নয় তো কী? অতএব ভোগব্যয় নিয়ে জাতীয় নমুনা সমীক্ষার সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানও চেপে দেওয়া হল।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করে আবার ‘লিক’ হল তথ্য। জানা গেল, সাড়ে চার দশকের মধ্যে এই প্রথম ভারতীয়দের মাথাপিছু প্রকৃত ব্যয় (অর্থাৎ, মূল্যস্ফীতির ফলে টাকার দাম কমার দরুন ব্যয় যতটা বেড়েছে, সেটাকে বাদ দিয়ে) কমল। ২০১১-১২’য় যেখানে এক জন গড়পড়তা ভারতীয় মাসে খরচ করতেন ১৫০১ টাকা, ২০১৭-১৮’য় এসে দেখা গেল তা কমে হয়েছে ১৪৪৬ টাকা। ফলে আশঙ্কা করা হচ্ছে দরিদ্র পরিবারের সংখ্যা বেড়েছে। জাতীয় নমুনা সমীক্ষার তথ্যের ভিত্তিতেই এ দেশে এত কাল দারিদ্রের পরিমাপ করে এসেছে যোজনা কমিশন। ২০১১-১২ সালের পর তা আর হয়নি। ইতিমধ্যে যোজনা কমিশন গিয়ে এসেছে নীতি আয়োগ। দারিদ্রের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে জানার জন্যে এই ২০১৭-১৮’র সমীক্ষাই একমাত্র সূত্র হতে পারত, সরকারের তুঘলকি সিদ্ধান্তে তা হতে পারল না। সম্পূর্ণ পরিসংখ্যান প্রকাশের দাবি উঠল আবার। তবে এ বার আর প্রতিবাদীদের পাত্তাও দিল না সরকার।
পরিবারের আয় বাড়লে ব্যয় বাড়ে, যদিও আয়বৃদ্ধির তুলনায় কম অনুপাতে। কিন্তু মাথাপিছু ব্যয় যদি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমতে থাকে? বুঝতে হবে, আয় বাড়ছে না। এমন ঘটনা বহুকাল ঘটেনি। আর ঘটেনি বলেই এই সমীক্ষালব্ধ তথ্য বিশেষজ্ঞের দৃষ্টিতে আর একটু খতিয়ে দেখার প্রয়োজন ছিল। ২০১৭-১৮ সালে যখন এই সমীক্ষা হয়, জাতীয় আয়ের বৃদ্ধি তখনও এতটা কমে আসেনি। তা হলে কি বলা যায়, ভোগব্যয় কমে যাওয়ার পরিণতি হিসেবেই আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি জাতীয় উৎপাদন তথা আয়ে ক্রমহ্রাসমাণ প্রবণতা? কারণ, ভোগব্যয় কমার অর্থ পণ্যের চাহিদা কমা, আর চাহিদা কমলে বিনিয়োগ কমে, উৎপাদন তথা জাতীয় আয়ে বৃদ্ধি কম। এটা যে হেতু দুইয়ে দুইয়ে চারের মতোই প্রাঞ্জল, তাই সরকারের নীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
গত এক বছর ধরে অর্থনীতির গতি হ্রাস পেয়েই চলেছে, যা আসলে যে চাহিদার অভাবের কারণে তা অনেকেই বলে আসছেন। কিন্তু সরকারপক্ষ সে কারণ ক্রমাগত অস্বীকার করে গিয়েছে হাস্যকর যুক্তি দিয়ে। উল্টে কর্পোরেট করের হারে ছাড় দেওয়া হয়েছে বিনিয়োগ ও বৃদ্ধিকে চাঙ্গা করতে। সমস্যা যখন চাহিদার অভাব, কর্পোরেট করের হারে ছাড় দিলে বিনিয়োগ বা উৎপাদন বাড়তে পারে না। তা বাড়েনিও বটে।
ভোগব্যয়ের কমে যাওয়ার হিসেব নিয়ে পদ্ধতিগত প্রশ্ন অনেক উঠতে পারে, বিশেষজ্ঞ মহলে যা অজ্ঞাত নয়। তারই দু’একটা এখানে আলোচনা করছি। মোট ভোগব্যয়ের আন্দাজ দু’ভাবে পাওয়া যেতে পারে। এক, জাতীয় আয় পরিমাপের মধ্যে দিয়ে। দুই, পরিবারের নমুনা সমীক্ষা করে। সামগ্রিক ভাবে দেখতে গেলে জাতীয় আয় বা মোট জাতীয় উৎপাদন আসলে চার রকমের ব্যয়ের সমষ্টি— ভোগব্যয়, বিনিয়োগ ব্যয়, সরকারের ব্যয়, আর রফতানি ও আমদানির পার্থক্য। ফলে জাতীয় আয় পরিমাপের সময়ে এই চার রকমের ব্যয়েরও পরিমাপ করা হয়, আর তাই অর্থনীতিতে মোট ভোগব্যয়ের পরিমাপও সেখান থেকে পেয়ে যাচ্ছি। অন্য দিকে, প্রতি পাঁচ বছর অন্তর জাতীয় নমুনা সমীক্ষা সংস্থা সরাসরি নমুনা পরিবারগুলি থেকে ভোগব্যয় বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে। সমস্যা হল, এই দুই উৎস থেকে প্রাপ্ত অর্থনীতিতে মোট ভোগব্যয়ের পরিমাণ কখনও মেলে না। আর এই অমিল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঢের বেড়েছে। যেমন, জাতীয় নমুনা সমীক্ষার হিসেবে দেখা যাচ্ছে ভারতীয় অর্থনীতিতে ২০১১-১২ থেকে ২০১৭-১৮’র মধ্যে ভোগব্যয়ের পরিমাণ কমেছে প্রতি বছর ০.৬ শতাংশ হিসেবে, অথচ জাতীয় আয় পরিমাপের হিসেবে দেখা যাচ্ছে ওই একই সময়ে তা বেড়েছে বছরে ৫.৮ শতাংশ হারে!
তবে এই অমিল যে বিশেষ ভাবে ভারতীয় ব্যাপার, তা নয়। বিশ্বের সব দেশেই কম-বেশি দেখা যায়। এর কারণও রয়েছে। নমুনা সমীক্ষা সব পরিবারকে অন্তর্ভুক্ত করে না, সংখ্যাতত্ত্বের নিয়ম মেনে বিশেষ ভাবে চিহ্নিত পরিবারগুলিকেই করে। সংখ্যাতত্ত্বের নিয়মানুসারে নমুনায় সব আয়গোষ্ঠীরই আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না, কারণ সমীক্ষায় বিশেষ ভাবে উচ্চবিত্তদের ধরা অপেক্ষাকৃত কঠিন। অনেক উচ্চবিত্তের বাড়িতে সমীক্ষাকারী হয়তো ঢুকতেই পারলেন না। এর সঙ্গে সম্পর্কিত অন্য সমস্যাটি হল, যে পণ্যগুলি খুব উচ্চবিত্তেরা ভোগ করেন তার মধ্যে অনেক পণ্য নিম্নবিত্ত বা গরিবরা ভোগ করেন না। ফলে উচ্চবিত্তদের ভোগ্যপণ্যগুলির আপেক্ষিক গুরুত্ব মোট ভোগব্যয়ে কম হয়ে যায়। এই সব কারণে সমীক্ষালব্ধ মোট ভোগব্যয়ের পরিমাণ জাতীয় আয়ের পরিমাপ থেকে প্রাপ্ত ভোগব্যয়ের পরিমাণের থেকে কম হওয়া স্বাভাবিক। আর তাই বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন সময়ে নানান উপায়ে এই দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা করে গিয়েছেন। সমীক্ষার ফলাফল যদি প্রকাশ করতেই না দেওয়া হয়, তা হলে সে উদ্যোগের আর কোনও সুযোগই থাকল না।
সাত মাস আগে যখন ঠিক এমনই ঘটনা ঘটেছিল, তখন এই পত্রিকায়ই যা লিখেছিলাম তা আবার মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে। যে কোনও পরিসংখ্যানকেই আঁতুড়ে নিকেশ করার এই যে প্রবণতা দেখছি, তা অতীব বিপজ্জনক। পরিসংখ্যান সংগ্রহ রাষ্ট্রের অন্যতম কাজ। কিন্তু বার বার যদি একটি নির্বাচিত সরকার এই কারণে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সংগৃহীত তথ্যকে প্রকাশ করতে না চায় যে তা অর্থনীতির স্বাস্থ্যের প্রশ্নে সরকারের পছন্দসই উত্তর দিতে পারছে না— তা হলে সমূহ বিপদ। কোনও পরিসংখ্যানই ষোলো আনা খাঁটি হয় না। আর সে জন্যেই বিশেষজ্ঞরা তাকে ঘষে মেজে গ্রহণযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করেন। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কর্তব্য এই প্রক্রিয়াটিকে চালু রাখা।
ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ়, কলকাতা