কর্মীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা ভর্তুকি দিবে সরকার, কিন্তু তাহার জন্য প্রতি মাসে সংস্থার কর্মী-সংখ্যা বাড়াইতে হইবে। সাবেক সোভিয়েট ইউনিয়নে এমন ফরমান জারি হইলে আশ্চর্য হইবার কারণ থাকিত না। নেহরু-ইন্দিরা যুগের ভারতেও। কিন্তু, ট্রিকল ডাউন অর্থনীতির দর্শনে বিশ্বাসী, বিনিয়োগ-কেন্দ্রিক গুজরাত-মডেলের জনক নরেন্দ্র মোদীর সরকার যদি এই পথে হাঁটে? অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের তৃতীয় দফা প্যাকেজে এমন শর্তই লুকাইয়া আছে। সরকার দেশে কর্মসংস্থান বাড়াইতে চাহে। তাহার জন্য বাণিজ্য-বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা যাইত, প্রয়োজনে সরকারই নূতন কর্মসংস্থান করিতে পারিত। কিন্তু, তাহার পরিবর্তে বেসরকারি সংস্থার উপর কর্মসংস্থানের শর্ত চাপাইয়া দিবার মধ্যে একটি নির্দিষ্ট মানসিকতা প্রকাশ পায়— সমাজতান্ত্রিক মানসিকতা। আরও স্পষ্ট ভাবে বলিলে, সর্বোচ্চ স্তর হইতে অর্থব্যবস্থার খুঁটিনাটি পরিচালনার যে প্রথা সমাজতন্ত্রের অন্তর্নিহিত, বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার সেই মনোভাবটিই লালন করে।
শুধু কর্মসংস্থানের প্রশ্নেই নহে, সমাজতন্ত্রের ভূত আরও অনেক ক্ষেত্রেই বাসা বাঁধিয়াছে। যেমন, গত কয়েক বৎসরে আমদানি ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের শুল্ক ও শুল্ক-বহির্ভূত বাধা তৈরি করা হইয়াছে। আপাত দৃষ্টিতে তাহা ভারতের অভ্যন্তরীণ শিল্পক্ষেত্রকে বৃদ্ধির সুযোগ করিয়া দিবার পন্থা। কিন্তু, ইতিহাস সাক্ষী, আমদানির পথে লক্ষ্যহীন বাধা সৃষ্টি করিয়া শেষ অবধি অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের সুবিধা হয় না— ভারতেও নহে, বিশ্বের অন্য কোনও প্রান্তেও নহে। যে দেশগুলি এই আমদানি-প্রতিস্থাপনের নীতি গ্রহণ করিয়া সফল, তাহাদের অর্থনৈতিক ভাবনায় একটি সুনির্দিষ্ট সময়-সারণি ছিল— কখন দরজা বন্ধ করা হইবে, কখন খোলা হইবে, সেই হিসাব ছিল স্পষ্ট। ভারতে তাহা করা দুরূহ। ফলে, আমদানি-প্রতিস্থাপনের নীতি শেষ অবধি রাজনীতির অস্ত্র হইয়া দাঁড়ায়। আবার, সম্প্রতি যে প্রোডাকশন-লিঙ্কড ইনসেনটিভ বা উৎপাদন-প্রণোদনার ব্যবস্থা হইল, প্রকৃত প্রস্তাবে তাহা আমলাতন্ত্রের উপর অতি নির্ভরশীল হইবে। লাইসেন্স রাজ-এর সুখস্মৃতি ফিরিয়া আসিবে, সেই আশঙ্কা প্রবল। তাহাও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। অর্থাৎ, ১৯৯১ সাল-পরবর্তী আর্থিক সংস্কার ভারতকে যে অন্ধকারগুলি হইতে উদ্ধার করিয়া আনিয়াছিল, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পৌরোহিত্যে ভারত সেই অন্ধকারেই প্রত্যাবর্তন করিতেছে। বোঝা যায়, নেহরুর সহিত তাঁহার বিবাদ শুধু আধুনিকতার প্রশ্নে— সমাজতন্ত্রের লৌহনিগড়ে তাঁহার আপত্তি নাই।
আপত্তির অবশ্য প্রশ্নও নাই, কারণ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীদের ভাবনা যে পাঠশালায় নির্মিত হইয়াছে, সেই নাগপুর আর্থিক নীতির ক্ষেত্রে অতীব বামপন্থী। উদার বাণিজ্য হইতে বিদেশি লগ্নি, সবেতেই তাহাদের আপত্তি আছে। বস্তুত, তাহাদের সহিত এ কে গোপালন ভবনের অবস্থানে ফারাক করিতে বসিলে পাত্রাধার তৈল না তৈলাধার পাত্র জাতীয় কূট তর্কের অবতারণা করিতে হইবে। উদার অর্থনীতির প্রতি বিরোধিতার কারণ একাধিক। প্রথমত, রাজনৈতিক ভাবে যে শ্রেণিটি বিজেপির প্রধানতম সমর্থনভিত্তি, সেই ক্ষুদ্র ও মাঝারি বণিক শ্রেণির স্বার্থের সহিত অর্থনৈতিক উদারবাদের প্রত্যক্ষ বিরোধ আছে— খুচরা বাণিজ্যে বিদেশি লগ্নির বিরোধিতা হইতে তাহা স্পষ্ট। সাঙাততন্ত্রের যুক্তিও আছে— বিদেশি পুঁজির পথ আটকাইয়া দিলে সরকার-ঘনিষ্ঠ কতিপয় লগ্নিকারীর বিপুল সুবিধা হইতে পারে বলিয়া অনেকেই সন্দেহ করেন। কিন্তু, বৃহত্তম কারণটি সম্ভবত নিয়ন্ত্রণেচ্ছা। গৈরিক জাতীয়তাবাদীরা যে ভাবে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রকে নিয়ন্ত্রণ করিতে চাহেন, উদার বাণিজ্য দর্শনগত ভাবে তাহার পরিপন্থী। মূল বিরোধ সম্ভবত এখানেই।