এত নীচে নামিতে হইবে, নরেন্দ্র মোদী নিজেও বোধ করি তাহা ভাবেন নাই। অর্থনীতির জ্ঞান তাঁহার প্রখর, এমন কথা প্রধানমন্ত্রীর অতি বড় বন্ধুও বলিবেন না। কিন্তু দেশ চালাইবার জন্য অর্থনীতিবিদ হইবার প্রয়োজনও নাই, মনমোহন সিংহের পূর্বসূরিদেরও অর্থনীতির প্রশিক্ষণ ছিল না। তবে কিনা, নিজে না জানিলে জানিয়া লইতে হয়। যাঁহারা জানেন তাঁহাদের কথা শুনিতে হয়। মোদীজির বড় সমস্যা, তিনি বলিতে শিখিয়াছেন, শুনিতে শেখেন নাই। বলা ভাল, যাহা শুনিতে তাঁহার ভাল লাগে না তাহা শুনিতে শেখেন নাই। তদুপরি, জনশ্রুতি, তাঁহাকে লোকে ভয় পায়। কেবল দূরের লোকেরা নহে, কাছের লোকেরাও। ফল যাহা হইবার তাহাই হইয়াছে। অর্থনীতির হাল খারাপ হইতে আরও খারাপ হইয়াছে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর পারিষদবর্গ ও উপদেষ্টামণ্ডলী সেই অপ্রিয় সত্য তাঁহাকে বলেন নাই। এহ বাহ্য। ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বরের সেই কালরাত্রিতে অসহায় ‘মিত্রোঁ’গণকে (বহুবচনের দ্বিত্ব মার্জনীয়) প্রধানমন্ত্রী যে সর্বনাশের পথে রওনা করাইয়াছিলেন, পরবর্তী তিন বছরে সেই পথেই অবিচল থাকিয়াছেন— অর্থনীতির জন্য যাহা করিবার, তাঁহার সরকার তাহা করে নাই, যাহা করিবার নহে তাহা করিয়াছে, করিয়া চলিয়াছে। কৌশিক বসু, রঘুরাম রাজন, মনমোহন সিংহ আদি অর্থশাস্ত্রী এবং/ অথবা বিশেষজ্ঞরা বারংবার সতর্ক করিয়াছেন। প্রধানমন্ত্রী শোনেন নাই। নির্মলা সীতারামন, পীযূষ গয়াল, রবিশঙ্কর প্রসাদ আদি ভক্তবৃন্দ ওই সমালোচকদের মুণ্ডপাত করিয়া বৃন্দগান গাহিয়াছেন: আমার চোখে তো সকলই শোভন। সেই গান শুনিয়া তাঁহাদের মহানায়ক বিগলিত হইয়াছেন। জিডিপি তথা জাতীয় আয় বৃদ্ধির হার ক্রমাগত নামিয়াছে। সাম্প্রতিক সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে জুলাই হইতে সেপ্টেম্বর, অর্থাৎ চলতি অর্থবর্ষের (২০১৯-২০) দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক পর্বে সেই হার পৌঁছাইয়াছে ৪.৫ শতাংশে। মোদী জমানায় ইহাই সর্বনিম্ন। আর একটু কষ্ট করিয়া ৩.৫ শতাংশে নামিতে পারিলেই ‘হিন্দু রেট অব গ্রোথ’-এর ইতিহাসে প্রত্যাবর্তন সম্পূর্ণ হইবে। হিন্দুত্ববাদের দর্শনে রামলালার মন্দির নির্মাণ অপেক্ষা সেই কৃতিত্ব বোধ করি কোনও অংশে কম নহে।
এই ক্রমিক অধঃপাতের মুখে দাঁড়াইয়া অর্থমন্ত্রী সীতারামন এখনও তাঁহার পাঠ্যবই আঁকড়াইয়া ধরিয়া প্রাণপণ আর্তনাদ করিতেছেন: আয়বৃদ্ধির গতি কমিলেই তাহাকে মন্দা (রিসেশন) বলে না। তিন বছর আগে শ্রীযুক্ত প্রকাশ কারাট যে ভাবে পাঠ্যবই ঘাঁটিয়া প্রমাণ করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন যে, নরেন্দ্র মোদীর জমানাকে যথার্থ ‘ফ্যাসিবাদ’ বলা চলে না, তাহার সহিত এই ‘না না, ইহা মন্দা নহে’ তত্ত্বের বিশেষ মিল রহিয়াছে। এই সূক্ষ্মবিচারে প্রধানমন্ত্রীর আহ্লাদ হইতে পারে, দেশের মানুষের দুশ্চিন্তা এক বিন্দুও কমিবে না। সত্য ইহাই যে, ভারতীয় অর্থনীতি বড় রকমের গাড্ডায় পড়িয়াছে। সামগ্রিক বিচারে জিডিপির মন্দগতির পাশাপাশি রহিয়াছে আরও উদ্বেগজনক সংবাদ: কয়লা, ইস্পাত, বিদ্যুৎ ইত্যাদি আটটি ‘কোর’ শিল্পের মোট উৎপাদন সেপ্টেম্বরে ৫.১ শতাংশ কমিবার পরে অক্টোবর মাসেও ৫.৮ শতাংশ কমিয়াছে— গত চোদ্দো বৎসরে এমন ফলাফল এই প্রথম। এই সঙ্কটের প্রথম এবং প্রধান কারণ, বাজারে চাহিদার জোর নাই। না ভোগ্যপণ্যের চাহিদা, না বিনিয়োগের চাহিদা। সরকারি এবং সরকারের গুণগ্রাহী ‘বিশেষজ্ঞ’রা তারস্বরে বলিতেছেন, অর্থনীতির মূল শক্তিগুলি (ফান্ডামেন্টালস) ঠিকঠাক আছে, কোনও চিন্তা নাই, চাকা ঘুরিবে, গতি বাড়িবে। এক দিন না এক দিন তাঁহাদের কথা সত্য হইবে, নিশ্চয়ই— যাহা নামে, তাহা শেষ অবধি ওঠে। অতএব আপাতত দেশবাসী (না-)মন্দার তাড়নায় পিষ্ট হইতে হইতে ‘ফান্ডামেন্টালস’ সেবন করিয়া তৃপ্ত থাকুন এবং মোদী-শাহির অর্থনৈতিক ইন্দ্রজাল অবলোকন করিয়া আমোদিত হউন।