রাজ্যপাল পদটি বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের খুব কাজে লাগছে
Governor

রাজনৈতিক ভারপ্রাপ্ত?

ধনখড়, কোশিয়ারী প্রথম নন। মোদী সরকারের আমলে রাজ্যপালদের দিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির নালিশ আগেও জমেছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২০ ০০:০১
Share:

রাজ্যপাল ঠাকুর রাম লাল যে তাঁকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছেন, তা আমেরিকার হাসপাতালে শুয়ে জানতে পারেন এন টি রাম রাও। এনটিআর— তেলুগু সিনেমার ‘লেজেন্ড’ তখন অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী। ওপেন হার্ট সার্জারি করাতে আমেরিকা যেতে হয়েছিল। সেখানেই খবর মিলল, রাজ্যপাল তাঁকে সরিয়ে তাঁর সরকারেরই ‘বিদ্রোহী’ মন্ত্রী এন ভাস্কর রাওকে মুখ্যমন্ত্রীর শপথ পাঠ করিয়েছেন। ভাস্করের কাছে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকা সত্ত্বেও!

Advertisement

অগস্ট ১৯৮৪। ইন্দিরা গাঁধী প্রধানমন্ত্রীর গদিতে। ঠাকুর রাম লাল যে নিছক ‘হাতের পুতুল’ ছিলেন, বলাই বাহুল্য। এন টি আর দেশে ফিরলেন। জনগণের কাছে বিচার চেয়ে রাজ্য সফরে বার হলেন। হাতে হাতে ফল। এক মাসের মধ্যে রাজ্যপাল বরখাস্ত হলেন। এনটিআর মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে ফিরলেন। রাজ্যপালকে রাজনৈতিক ঘুঁটি করতে গিয়ে লাভ হল না কিছুই। ঘুঁটিটাই মারা পড়ল।

ফিরে আসি ২০২০-র ভারতে। পূর্বের পশ্চিমবঙ্গ ও পশ্চিমের মহারাষ্ট্র— দুই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এখন তাঁদের রাজ্যপালকে নিয়ে বীতশ্রদ্ধ। কলকাতার রাজভবন থেকে জগদীপ ধনখড় মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কখনও প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন। কখনও আবার লম্বা লম্বা চিঠি লিখে ‘গাফিলতি’ ধরিয়ে দিচ্ছেন। রাজ্যপাল চিঠি লিখতেই পারেন। পরামর্শ দিতেই পারেন। কিন্তু সেই চিঠি নিয়ম করে সংবাদমাধ্যমে ‘ফাঁস’ হচ্ছে। মহারাষ্ট্রের ভগৎ সিংহ কোশিয়ারী আবার মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরেকে বিধান পরিষদে মনোনীত করা নিয়েই টালবাহানা করছেন।

Advertisement

ধনখড়, কোশিয়ারী প্রথম নন। মোদী সরকারের আমলে রাজ্যপালদের দিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির নালিশ আগেও জমেছে। কর্নাটক থেকে মধ্যপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড থেকে অরুণাচল প্রদেশ, রাজ্যপালরা নাকি বিজেপি বা সঙ্ঘের নেতাদের মতো আচরণ করেছেন। সেখানে কংগ্রেস বা কংগ্রেসের জোট সরকারের গদি উল্টে বিজেপিকে ক্ষমতায় আনার পিছনে রাজ্যপালদের ভূমিকা ছিল বলে অভিযোগ। গোয়া, মণিপুরের ভোটে বিজেপি না জিতেও সরকার গড়ে ফেলেছে। সে-ও না কি রাজ্যপালদের ‘বদান্যতা’য়। দিল্লি, পুদুচেরি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। সেখানেও উপরাজ্যপালদের নাক গলানো নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীদের ঢের নালিশ। কয়েক জন ব্যতিক্রম রয়েছেন। তাঁরা সরকারের কাজে তেমন নাক গলান না। তবে টুইটারে কার্যত আরএসএস-প্রচারকের মতোই মন্তব্য করেন বলে খবরে প্রকাশ।

গত বছর মহারাষ্ট্রের ভোটের পর কেউই সরকার গড়তে না পারায় রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়ে যায়। শিবসেনা-কংগ্রেস-এনসিপি মিলে সরকার গঠনের প্রস্তুতি যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, সে সময় এক দিন রাত দুটোয় সরকার গড়ার দাবি জানিয়ে রাজ্যপাল ভগৎ সিংহ কোশিয়ারীর কাছে চিঠি দেন বিজেপির দেবেন্দ্র ফডণবীস। ভোর পৌনে ছ’টায় রাষ্ট্রপতি শাসন প্রত্যাহারের পরে সকাল আটটায় রাজ্যপাল দেবেন্দ্রকে শপথ পাঠ করান। বাকি দলের নেতাদের ঘুম ভাঙার আগেই খেল খতম। সৌজন্যে রাজ্যপাল। খেলা অবশ্য তিন দিনেই ঘুরে যায়। উদ্ধব ঠাকরে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন। তাঁকে হয় বিধানসভায় জিতে আসতে হবে, নয়তো বিধান পরিষদে মনোনীত হতে হবে। সেখানেই বাধ সাধছেন রাজ্যপাল কোশিয়ারী।

রাজ্যপালের ক্ষমতা কতটুকু, তাঁর দায়িত্ব কী, তাঁর গণ্ডি কতখানি— তা নিয়ে সংবিধান প্রণয়নের সময় গণ পরিষদে কম বিতর্ক হয়নি। সংবিধান তৈরির পরেও সুপ্রিম কোর্টে বা নানা সরকারি কমিটিতে এ নিয়ে চুলচেরা বিচার হয়েছে। জওহরলাল নেহরুও মনে করতেন, নাক না গলিয়েও রাজ্যপাল অনেক কিছু করতে পারেন। ১৯৫২-র ১৮ মে মুখ্যমন্ত্রীদের লেখা চিঠিতে নেহরু বলছেন, ‘রাজ্যপালের উচিত যে কোনও বিষয়ে দরকার মনে করলে পরামর্শ দেওয়া। এ বার সেই পরামর্শ গ্রহণ করবেন কি করবেন না, তা মন্ত্রীদের ব্যাপার।’ নেহরুর নিজের প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় রাজ্যপালকে রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগানোর অভিযোগ এক বারই উঠেছে। ১৯৫৯-এ ই এম এস নাম্বুদ্রিপাদের মুখ্যমন্ত্রিত্বে প্রথম নির্বাচিত বাম সরকারকে অপসারণের সময়। হাতিয়ার হিসেবে কেরলের তদানীন্তন রাজ্যপাল বি রামকৃষ্ণ রাওয়ের ‘সুপারিশ’-কে কাজে লাগানো হয়েছিল।

কংগ্রেসিরা ছাড়া আর সব রাজনীতিকরাই একটা কথা দলমতনির্বিশেষে মনে করেন যে, স্বাধীন ভারতে ইন্দিরা গাঁধীর মতো আর কোনও প্রধানমন্ত্রীই রাজ্যপালদের নিজের রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগাতে পারেননি। ১৯৬৬ থেকে ’৭৭, তার পরে ১৯৮০ থেকে ’৮৪— দুই দফাতেই তাঁর ট্র্যাক রেকর্ড ‘ঈর্ষণীয়’। রাজ্যপালকে কাজে লাগিয়ে পশ্চিমবঙ্গে অজয় মুখোপাধ্যায়ের সরকার, উত্তরপ্রদেশে চৌধুরী চরণ সিংহের সরকারের অপসারণ সেই পথেরই এক একটি স্মরণীয় মাইলফলক।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সেই পথে হাঁটবেন না বলেই প্রত্যাশা ছিল। তিনি নিজে দীর্ঘ সময় গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর পদে ছিলেন। তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বের অনেকটা সময়ই কেন্দ্রে কংগ্রেস ক্ষমতায় থেকেছে। ফলে রাজ্যপাল কাজে নাক গলালে মুখ্যমন্ত্রীদের কী অসুবিধা হতে পারে, তা তাঁর অজানা নয়। প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসে মোদী যখন সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনের কথা বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রীদের সমন্বয়ে ‘টিম ইন্ডিয়া’ তৈরির মন্ত্র নিয়েছিলেন, তখন অনেকেই মনে করেছিলেন, অন্তত এ ক্ষেত্রে ‘অচ্ছে দিন’ আসছে। এখন সেই মোদীর বিরুদ্ধেই অভিযোগ, করোনা মোকাবিলার অধিকাংশ সিদ্ধান্ত তিনি দিল্লিতে বসে একতরফা নিচ্ছেন। রাজ্যগুলিকে আর্থিক সাহায্য করছে না তাঁর সরকার। উল্টে রাজ্যপালরা মুখ্যমন্ত্রীদের কাজে নাক গলাচ্ছেন। এবং কেউ এই অভিযোগ তুললেই বিজেপি নেতাদের বাঁধা গত: কংগ্রেসের জমানায় কী হয়েছিল?

মুশকিল হল, ইন্দিরা-জমানার পরে রাজ্যপালদের খুব বেশি রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগানোর অভিযোগ বিজেপি নেতারাও খুঁজে পাচ্ছেন না। বিশেষত সাম্প্রতিক অতীতে মনমোহন সিংহের জমানায় এমন উদাহরণ বিশেষ নেই। মনমোহন-জমানার দ্বিতীয়ার্ধে সুশীল কুমার শিণ্ডেকে দু’বছর অন্ধ্রের রাজ্যপাল থাকার পরেও তাঁকে কেন্দ্রের মন্ত্রী করা নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। রাজ্যপাল হওয়ার আগে কেউ কোনও রাজনৈতিক দলে থাকতেই পারেন। কিন্তু এক বার রাজভবনে ঢুকে পড়ার পরে তিনি অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠবেন, এটাই কাঙ্ক্ষিত।

মনমোহন জমানার গোড়ার দিকে একটা বিতর্ক হয়। বাজপেয়ী সরকারকে বিদায় জানিয়ে ইউপিএ ক্ষমতায় আসার পরেই উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত, হরিয়ানা ও গোয়ার রাজ্যপালকে সরানো হয়। অলিখিত কারণ, বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রী, কৈলাসপতি মিশ্র, বাবু পরমানন্দ, কেদারনাথ সাহনি, সকলেরই আঁতুড় ঘর আরএসএস। মনমোহন-সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিজেপি সাংসদ বি পি সিঙ্ঘল সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিলেন। সুপ্রিম কোর্ট এই মামলার রায়ে রাজ্যপালের প্রসঙ্গে কিছু কথা বলেছিল। তা হল, রাজ্যপালের রাজনৈতিক ইতিহাস যা-ই হোক না কেন, তিনি অরাজনৈতিক থাকবেন, এমনটাই প্রত্যাশিত। তিনি নিখাদ সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করবেন। রাজ্যপাল কখনওই রাজনৈতিক ভাবে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারেন না। রাজ্যপাল কেন্দ্রীয় সরকারের ‘কর্মচারী’ বা ‘এজেন্ট’ নন।

কিন্তু প্রশ্ন হল, রাজভবনকে রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগালে কি সত্যিই রাজনৈতিক লাভ হয়?

গোড়ার গল্পে ফিরে যেতে হয়। সেই ১৯৮৪-তে। সেপ্টেম্বর মাসে এন টি রাম রাও ফের অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসলেন। পরের মাসেই আততায়ীর গুলিতে নিহত হলেন ইন্দিরা। গোটা দেশের সহানুভূতির ঢেউ রাজীব গাঁধীর ভোট-বাক্সে আছড়ে পড়ল। সব রাজ্যেই কংগ্রেসের জয়জয়কার। বাকিরা কার্যত ধুয়েমুছে সাফ। ব্যতিক্রম অন্ধ্রপ্রদেশ ও এনটিআর-এর দল। কংগ্রেসের পরেই দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হল তেলুগু দেশম পার্টি। সেই প্রথম কোনও আঞ্চলিক দল লোকসভায় প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা পেল।

ইতিহাস কোনও এক প্রাক্তন রাজ্যপাল ঠাকুর রাম লালকে মনে রাখেনি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement