প্রতিরোধ: সংসদ ভবনের সামনে কৃষি আইন সংশোধনের প্রতিবাদে বিরোধী শিবিরের জনপ্রতিনিধিরা। নয়াদিল্লি, ২৩ সেপ্টেম্বর। পিটিআই
নিমাই রায় সমাজতত্ত্বে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পান ১৯৮৮ সালে, তার পর চাষবাসে মন দেন। তিনি কৃষক হতে চেয়েছিলেন। এখন ওড়িশার জাজপুরে ১২ একর জমিতে বছরে একাধিক ফসল ফলান। দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় (২২-৯) তাঁর কথা পড়লাম। কৃষিপণ্য সংক্রান্ত আইন সংশোধন নিয়ে তাঁর বক্তব্য, এর ফলে ক্রমশ কৃষির নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে বড় মাপের কারবারিদের হাতে, তাঁরা ঠিক করবেন জমিতে কী ফসল ফলানো হবে। ‘‘যে কৃষকের এক দিন নিজের জমি ছিল তিনি সেই জমিতেই মজুর খাটবেন।’’ চাষি দেখবেন, তাঁর স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে, তিনি একটা কোম্পানির শ্রমিকে পরিণত হয়েছেন।
কথাটা নানা প্রশ্ন ওঠাতে পারে। জন্মজন্মান্তর কৃষিজমিতে বাঁধা পড়ে থাকাটা স্বাধীনতা? এই আইনের ফলে যদি জমি বিক্রি করে অন্য পেশায় যাওয়ার প্রবণতা বাড়ে, তাতেই তো স্বাধীনতার প্রসার ঘটবে। জীবিকা নির্বাচনের স্বাধীনতা। আর, সরকার তো চাষিকে জমি বেচতে বলছে না! নতুন আইন বরং বলছে: কৃষক নিজের ফসল যাকে খুশি যেখানে খুশি বিক্রি করতে পারবেন, সরকার-নিয়ন্ত্রিত ‘মান্ডি’তে বিক্রির বাধ্যবাধ্যকতা থাকবে না, এবং সুযোগ পেলে যে কোনও কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করতে পারবেন, কী ফসল ফলাবেন, তার কী দাম পাবেন, সবই চুক্তিতে থাকবে। এতেও আপত্তি?
সরকারি বয়ানেও কৃষকের স্বাধীনতার জয়ধ্বনি। প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ করেছেন, কৃষিপণ্য বিপণন কমিটি (এপিএমসি) তথা সরকার অনুমোদিত মান্ডি ও তার মাতব্বরদের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে কৃষক ফসল বিক্রির স্বাধীনতা পেলে দালালদের প্রভুত্ব চলে যাবে, বিরোধীরা সেটা মানতে পারছেন না, কারণ তাঁদের কায়েমি স্বার্থও স্থিতাবস্থার সঙ্গে জড়িত। সরকারি ‘বিশেষজ্ঞ’রা নব্বইয়ের দশকের আর্থিক সংস্কারের প্রসঙ্গ তুলে বলেছেন, এত দিনে ভারতীয় কৃষিও উদার অর্থনীতির মুক্তাঙ্গনে দাঁড়ানোর সুযোগ পেল, কৃষক অবশেষে স্বাধীনতার স্বাদ পাবেন।
ষাটের দশকে তৈরি এপিএমসি নিয়ে বিস্তর সমালোচনা। মান্ডির পরিসরে দালালের দাপট সত্যই প্রবল। অন্য দিকে, অধিকাংশ কৃষক সেই পরিসরের বাইরেই থেকে গেছেন— বহু এলাকাতেই ছোট এবং মাঝারি চাষিরা আজও প্রধানত স্থানীয় মহাজন আড়তদার ইত্যাদি ক্ষমতাগোষ্ঠীর ওপর নির্ভরশীল, প্রায়শই তাদের কুক্ষিগত। কী ভাবে এই ব্যবস্থার সংস্কার করে ক্ষমতাবানদের কবল থেকে চাষিদের মুক্ত করা যায়, সে-সব নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা হয়েছে, সুপারিশের স্তূপ জমেছে, রাজনীতি এবং আমলাতন্ত্রের স্বার্থ সেগুলির রূপায়ণ হতে দেয়নি। আজ যাঁরা কৃষি বিল সংশোধনের বিরোধিতায় সরব, তাঁদের অনেকেই সেই স্বার্থের প্রতিভূ, তাঁরা যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন প্রয়োজনীয় সংস্কার হয়নি।
কিন্তু নরেন্দ্র মোদীরা যেটা চাইছেন, তার নাম সংস্কার নয়, বিসর্জন। তাঁদের বিধান হল— সাংবাদিক তথা সমাজকর্মী পি সাইনাথের ভাষায়— ‘অসুখ করেছে? মেরে ফেলো।’ সরকার অবশ্যই এ-কথায় ঘোর আপত্তি জানাবে। তাদের প্রচারকরা বড় গলায় বলছেন, এপিএমসি তুলে দেওয়া হচ্ছে না, মান্ডিও থাকবে, চাষিরা ইচ্ছে করলে সেখানেও ফসল বিক্রি করতে পারবেন। কিন্তু আমরা জানি, সরকারি দোকান বন্ধ না করেও কী ভাবে তার সর্বনাশ করে দেওয়া যায়। ওষুধ উৎপাদন থেকে শুরু করে টেলিফোন পরিষেবা অবধি নানা ক্ষেত্রে তার বিস্তর নমুনা আমরা দেখেছি, দেখছি। এমনকি ভারতীয় রেলও এখন সে-পথেই চলেছে। তাই সরকারি প্রচারকদের আশ্বাসের দাম ক’পয়সা, সেটা কারও অজানা নয়। তেমনই, কৃষিপণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) নিয়ে আশ্বাসের কমতি নেই, কিন্তু নয়া ব্যবস্থায় এমএসপির কতটুকু কার্যকারিতা অবশিষ্ট থাকবে, তা নিয়ে ঘোর সংশয়।
কিন্তু মূল প্রশ্ন এপিএমসি বা মান্ডি নিয়ে নয়, মূল প্রশ্ন একটি ধর্মমত নিয়ে। সে বলে: বাজারের হাতে সব কিছু ছেড়ে দিলেই স্বাধীনতা মিলবে। আশির দশকেই এই ধর্মপ্রচার জোরদার হয়, দিল্লির তখ্তে সেই মতাদর্শের প্রতিষ্ঠা নব্বইয়ের গোড়ায়, মোদীর রাজত্বে তার পালে জোর হাওয়া লাগে, অতিমারির কালে সে-হাওয়া ঝড়ের রূপ নিয়েছে। আমাদের থালাবাটি বাজানোর অবকাশে দেখতে দেখতে কয়লাখনিতে বেসরকারি পুঁজির প্রবেশ অবারিত হয়েছে, তাকে স্বাগত জানানো হয়েছে রেলপথেও, আরও বহু পুঁজিমালিকের হাতে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের অবাধ অধিকার তুলে দেওয়া হয়েছে, এ বার এপিএমসি’র নিয়ন্ত্রণ সরিয়ে নিয়ে ও চুক্তিচাষে অনুমোদন দিয়ে কৃষিপণ্যের বাজারও খুলে দেওয়া হল, অত্যাবশ্যক পণ্য মজুত করতেও আর বাধা থাকল না, এমনকি জানিয়ে দেওয়া হল যে, চাল-ডাল-আলু-পেঁয়াজের দামও ‘যথেষ্ট’ না বাড়লে বাজারে হস্তক্ষেপ করা হবে না। শাসক দল যে বেপরোয়া বিক্রমে কাঁড়ি কাঁড়ি বিল পাশ করিয়ে ছেড়েছে, তাতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। অর্থনীতিকে ঢাকিসুদ্ধ কর্পোরেট পুঁজির হাতে
তুলে দেওয়ার লক্ষ্য পূরণে কোভিড অপ্রত্যাশিত সুযোগ এনে দিয়েছে, রাষ্ট্রযন্ত্রীরা কব্জি ডুবিয়ে তার সদ্ব্যবহার করছেন। এখন বড় প্রতিবাদ গড়ে তোলা কঠিন, গড়ে তুলতে চাইলেও দূরত্ববিধির সুযোগে রাষ্ট্র তাকে সহজেই দমন করতে পারবে, অতএব— আর দেরি নয়।
ধর্মমতের মহিমা হল, তাকে যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করার দরকার হয় না, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু। বিশ্বাস যদি পাকা হয়, চোখের সামনে বিপরীত সাক্ষ্যপ্রমাণ খাড়া থাকলেও ভক্তরা বৃন্দগান জারি রাখেন। এমন বিশ্বাস আকাশ থেকে পড়ে না, তার জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। বাজারের স্বাধীনতাই প্রকৃত স্বাধীনতা— নিয়োলিবারাল অর্থনীতি নামক ধর্মমতের এই বীজমন্ত্রটির প্রতি জনগণমনে বিশ্বাস সৃষ্টি এবং লালনের জন্যও বিপুল আয়োজন করেছেন সেই অর্থনীতির চালক ও নায়করা। তার মহিমা এমনই যে, বাজারতন্ত্রের দুনিয়া-জোড়া দুঃশাসন এবং বিপর্যয় দেখতে দেখতেও তথাকথিত শিক্ষিত, এমনকি শিক্ষাবিদ অভিধায় পরিচিত ব্যক্তিরাও বিস্মিত প্রশ্ন তোলেন, ‘‘প্রতিবাদীরা একটা কথা বুঝিয়ে দেবেন? কৃষকরা যদি বাজারে ফসল বিক্রির স্বাধীনতা পান, তাতে ক্ষতি কী হবে?’’
প্রশ্নকর্তারা একটি সহজ কথা ভেবে দেখতে পারেন। যে বাজারে কৃষকের ফসল বিক্রির স্বাধীনতা নিয়ে তাঁদের এত সন্তুষ্টি, সেই বাজার কার নিয়ন্ত্রণে চলছে? দুনিয়া জুড়ে কৃষিপণ্যের বাজারে বড় পুঁজির আধিপত্য কী ভাবে বেড়েছে, তা কোনও গোপন খবর নয়! যে কৃষক মহাজন বা কমিশন এজেন্ট-এর হাতে মার খাচ্ছেন, তিনি কর্পোরেট অধিপতিদের হাতে মার খাবেন না? তিনি মার না খেলে ওঁদের মুনাফা বাড়বে কী করে? যে অগণন ভারতীয় কৃষক আত্মঘাতী হয়ে চলেছেন, তাঁদের এক বিরাট অংশ এই কর্পোরেট পুঁজি শাসিত বাজারতন্ত্রেরই শিকার। শুধু কৃষি? স্কুল কলেজ হাসপাতাল বড় পুঁজির হাতে তুলে দেওয়ার পরিণাম কী, আমরা জানি না? ‘খোলা বাজার’-এ স্বাস্থ্য পরিষেবা বেছে নেওয়ার মহান স্বাধীনতা কী ভাবে বহু মানুষের পক্ষে প্রাণঘাতী হতে পারে, আরও বহু মানুষকে সর্বস্বান্ত করতে পারে— সেই নির্মম সত্যের অনন্ত প্রদর্শনী আমরা দেখছি না?
নিমাই রায় এই সত্য দেখেছেন, বুঝেছেন। তিনি একা নন। দেশ জুড়ে বহু মানুষের অভিজ্ঞতা তাঁদের জানিয়ে দিচ্ছে যে, অর্থনীতির অন্য নানা পরিসরের মতোই কৃষিপণ্য এবং কৃষকের জীবন-জীবিকাকে বড় পুঁজির মৃগয়াভূমি হিসেবে চিহ্নিত করার নতুন পর্ব শুরু হবে এ বার। কৃষিপণ্যের বাজার দখলের সূত্র ধরে জমি দখলের অভিযান জোরদার হবে। জমি অধিগ্রহণ আইন কৃষককে যেটুকু রক্ষাকবচ দিয়েছে, সেটুকুও কেড়ে নেওয়ার উদ্যোগ ইতিমধ্যেই দেখা গেছে, সম্মিলিত প্রতিরোধে এক বার সে উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে বলে ফের আক্রমণ হবে না— পুঁজিতন্ত্রে এমন বিধান কস্মিন্কালেও নেই। কৃষিজমি উৎপাদনের উপকরণ। পুঁজিতন্ত্রের অমোঘ লীলায় ক্রমশ বহু কৃষকের হাত থেকে সেই উপকরণ চলে যাবে, নিজস্ব সম্পদ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কৃষক শ্রমের বাজারে এসে দাঁড়াবেন তাঁর শ্রমশক্তি বিক্রয়ের জন্য, যে শ্রমশক্তি ছাড়া তাঁর আর কোনও সম্বল নেই।
সেই বাজারটিকেও স্বাধীনতা দিতে তৎপরতার অন্ত নেই। শ্রম আইন সংশোধনের জন্য যে সংসদের বাদল অধিবেশনের শেষ দিনটিই বাছা হল, তার প্রতীকী তাৎপর্য খেয়াল না করলে চলে না। এই সংশোধনের মূল লক্ষ্য একটাই: শ্রমিক নিয়োগ এবং ছাঁটাইয়ে নিয়োগকর্তাদের নিরঙ্কুশ অধিকার কায়েম করা। রাজ্য সরকার বা শ্রমিক সংগঠন, কারও এ ব্যাপারে কোনও ভূমিকা থাকবে না আর। ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে মুখোমুখি দাঁড়াবেন শ্রমশক্তির সব-হারানো বিক্রেতা এবং সর্বগ্রাসী ক্রেতা। ভক্তরা বাষ্পাকুল চোখে অবলোকন করবেন, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাজারের নিরাবরণ স্বাধীনতা। পূর্ণ স্বরাজ।