Budget 2020

অ-শিক্ষার অভিযান

শিক্ষায় ব্যয়বরাদ্দ সঙ্কোচনের এই ধারাটি বিচ্ছিন্ন বিষয় নহে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০১:২২
Share:

অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের বাজেট বক্তৃতায় ২০২০-২১ অর্থবর্ষে শিক্ষা খাতে ৯৯৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দের গর্বিত ঘোষণা শুনিয়া শ্রোতারা অনেকেই হয়তো ভাবিয়াছিলেন, শিক্ষার প্রসারে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিজ্ঞা দৃঢ়, উদ্যম প্রবল। সংখ্যাটি শুনিতে অনেক। কিন্তু সরকারি ব্যয়বরাদ্দের অঙ্ককে দেখিতে হয় অতীতের সহিত তুলনা করিয়া। তুলনাই বলিয়া দেয়, বরাদ্দ কতটা বাড়িতেছে। ২০১৯-২০ সালে কেন্দ্রীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ হইয়াছিল প্রায় ৯৪৮০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ, গত বছরের তুলনায় শিক্ষা বাজেট বাড়িয়াছে ৫ শতাংশেরও কম। ইহার উপর এক বছরের মূল্যবৃদ্ধির হিসাব ধরিলে বুঝিতে হয়, প্রকৃত অর্থে শিক্ষা বরাদ্দ আদৌ বাড়ে নাই। তদুপরি, এক বছরে জনসংখ্যা বাড়িয়াছে, সুতরাং মাথাপিছু শিক্ষা ব্যয় কমিয়াছে। এবং এক বছরে জিডিপি বা জাতীয় আয় নয় নয় করিয়াও প্রায় ৫ শতাংশ বাড়িয়াছে, সুতরাং কমিয়া গিয়াছে জিডিপির অনুপাতে শিক্ষা বরাদ্দ। এই সব অপ্রিয় সত্যের একটিও অর্থমন্ত্রী তাঁহার বক্তৃতায় বলেন নাই, বক্তৃতার পরে নানাবিধ মন্তব্যেও বলেন নাই। বলিবার কথাও নহে, কারণ এই সত্য কেবল অপ্রিয় নহে, লজ্জাকর। বহু কাল ধরিয়া জিডিপির অনুপাতে (কেন্দ্রের ও রাজ্যগুলির সম্মিলিত) সরকারি শিক্ষা-ব্যয় ৬ শতাংশে তুলিবার কথা বলিয়া আসিতেছেন শিক্ষাবিদেরা, অথচ তাহা আজও ৩ শতাংশের আশেপাশে ঘোরাফেরা করিতেছে। এই বাজেটের পরে অনুপাতটি আরও কিছুটা কমিবে। শিক্ষা বিষয়ে সরকারি আগ্রহ যে কত জোরদার, তাহা বুঝিতে অসুবিধা নাই।

Advertisement

শিক্ষায় ব্যয়বরাদ্দ সঙ্কোচনের এই ধারাটি বিচ্ছিন্ন বিষয় নহে। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাবিত নয়া শিক্ষা নীতির দলিলে বিস্তর বাহ্বাস্ফোটের পিছনে যে মূল প্রক্রিয়াটি প্রকট, তাহার নাম শিক্ষার বাজারিকরণ। বাজেটও তাহার অনুগামী। বস্তুত, ইহা তাঁহাদের সামগ্রিক চিন্তাধারার অনুসারী। তাঁহাদের ধারণায় শিক্ষা, বিশেষত উচ্চশিক্ষা ভবিষ্যৎ উপার্জনের মূলধনমাত্র, সুতরাং ছাত্রছাত্রী তথা অভিভাবকদের তাহার জন্য বিনিয়োগ করিতে হইবে। দ্বিতীয়ত, তাঁহাদের বিশ্বাস— সেই বিনিয়োগের সামর্থ্য যাঁহার আছে তিনিই বিনিয়োগ করিবেন, অসচ্ছল শিক্ষার্থীর দায় সরকারের নহে। এই মতাদর্শের কারণেই জেএনইউয়ের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খরচ এক ধাক্কায় বিপুল হারে বাড়াইবার ধনুর্ভঙ্গ পণ করিয়াছেন শাসকদের একান্ত অনুগত কর্তৃপক্ষ। এই বিশ্বাসের পরিণামেই নির্মলা সীতারামনের বাজেটে কলেজের ছাত্রছাত্রীদের সরকারি বৃত্তির জন্য সীমিত ব্যয়বরাদ্দ বাড়িবার বদলে কমিয়া গিয়াছে। অনিবার্য ভাবেই, এই ধরনের ব্যবস্থার কোপ পড়ে প্রধানত দরিদ্র এবং অনগ্রসর বর্গের শিক্ষার্থীদের উপর, তাঁহাদের অনেকের পক্ষে পড়াশোনা চালাইয়া যাওয়াই দুঃসাধ্য হয়। উচ্চশিক্ষায় এই বর্গের উপস্থিতি এমনিতেই অত্যন্ত কম, শিক্ষাদরদি সরকারের আশীর্বাদে তাহা আরও কমিবে। বাড়িয়া চলিবে শিক্ষার অসাম্য।

এই অসাম্য কেবল সামাজিক ন্যায়ের বিরোধী নহে, যথার্থ উন্নয়নেরও বিরোধী। প্রথমত, শিক্ষার সুযোগ যদি বহু জনের নিকট প্রসারিত না হয়, তবে কর্মক্ষম নাগরিকেরা, বিশেষত বিপুল এবং ক্রমবর্ধমান তরুণসমাজের ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ অন্ধকার। আধুনিক ‘নলেজ ইকনমি’ তো দূরস্থান, কৃষি বা নানা দৈনন্দিন পরিষেবার মতো চিরাচরিত ক্ষেত্রেও তাঁহারা যথাযথ কাজ পাইবেন না। দ্বিতীয়ত, উচ্চশিক্ষার পরিসর সমাজের সুবিধাভোগী অংশের জন্য সীমিত থাকিলে জ্ঞানচর্চাও খণ্ডিত থাকিতে বাধ্য, কারণ দেশের ও দুনিয়ার বৃহত্তর বাস্তবের সহিত সংযোগ না থাকিলে নূতন চিন্তা ও উদ্ভাবনী শক্তির যথেষ্ট বিকাশ ঘটে না। শাসকেরা অবশ্য ‘দক্ষতা’ বিকাশের জন্য ৩০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করিয়া এবং কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে প্রচুর টাকা ও ‘অসামান্য’ তকমা প্রদান করিয়াই ভাবিতেছেন, শিক্ষার বিকাশ হইবে। অ-শিক্ষা অতি ভয়ানক বস্তু।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement