অতঃপর, অন্তত একটি আধার কার্ড কম তৈরি করিতে হইবে। ঝাড়খণ্ডের এগারো বৎসর বয়সি সন্তোষী কুমারীর নামটি কাটা পড়িল। অবশ্য, সন্তোষী মরিয়া গেল বলিয়া তাহার জন্য আধার কার্ডের প্রয়োজন ফুরাইল, নাকি আধার কার্ড এমনই প্রয়োজনীয় হইয়া উঠিয়াছিল যে তাহার অভাবে শেষ অবধি সন্তোষীকে মরিতে হইল, সেই তর্কটি থাকিবে। ঝাড়খণ্ডের সিমডেগা জেলার বাসিন্দা সন্তোষীর হতদরিদ্র পরিবারটির রেশনকার্ডগুলি আধার নম্বরের সহিত সংযুক্ত হয় নাই। এ দিকে, ঝাড়খণ্ড ‘আদর্শ আধার রাজ্য’ হইতে মরিয়া, যেখানে রেশন, একশত দিনের কাজ, সবই আধার-এর সহিত যুক্ত করা বাধ্যতামূলক। ফলে, স্থানীয় প্রশাসন সন্তোষীদের পরিবারটিকে গণবণ্টনের তালিকা হইতে ছাঁটিয়া ফেলে। দিনে অন্তত এক বেলা পেট ভরাইবার ভরসা ছিল স্কুলের মিড ডে মিল। পূজার ছুটি পড়ায় সেই ভরসাটিও যায়। অভিযোগ উঠিয়াছে, নিছক খাদ্যভাবেই সন্তোষী মরিয়া গেল। প্রশাসন অভিযোগটি মানিতে চাহে নাই। খাতায় কলমে সন্তোষীর মৃত্যুর কারণটি ঠিক কী, সেই বিতর্ক অবান্তর। কারণ, মেয়েটি যে অনাহারে ছিল, তাহা তর্কাতীত।
সুপ্রিম কোর্টের স্পষ্ট নির্দেশ আছে যে আধার কার্ড না থাকিবার কারণে যেন কোনও ব্যক্তিকে তাহার প্রাপ্য হইতে বঞ্চিত না করা হয়। কেন্দ্রীয় সরকার সেই নির্দেশের তোয়াক্কা করে নাই। একের পর এক ক্ষেত্রে আধার বাধ্যতামূলক হইয়াছে। আধার দাঁড়াইয়া আছে যে প্রযুক্তিগুলির উপর, তাহার কোনওটিই নিখুঁত নহে। বায়োমেট্রিক তথ্য যাচাই সর্বদা নির্ভুল হয় না। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত হইতে অভিযোগ আসিতেছে যে বিশেষত শ্রমজীবী মানুষদের হাতের ছাপ মিলিতেছে না। তাহার জন্য কাহারও একশত দিনের কাজের মজুরি পাওয়া আটকাইয়া যাইতেছে, কেহ পেনশন পাইতেছেন না। তাহার উপর আছে দুর্বল ইন্টারনেট সংযোগ। দিনের অধিকাংশ সময় ইন্টারনেট চলে না বলিয়া ব্যাংকও অচল হইয়া থাকিতেছে। তাহাতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি। বিশেষত গরিব মানুষের, যাঁহারা জীবনধারণের জন্য সরকারের উপর অসহায় ভাবে নির্ভরশীল। সন্তোষী কুমারী যেমন ছিল।
রাষ্ট্র এই নির্ভরশীলতাকে ঠিক কী চোখে দেখে, সন্তোষীর মৃত্যু তাহার মস্ত প্রমাণ। নরেন্দ্র মোদীরা দেশের একশত ত্রিশ কোটি মানুষকে আধার-এর আওতায় আনিতে চাহেন। কেন, সেই প্রশ্ন অন্যত্র। কিন্তু, তাঁহারা জানেন, মানুষকে বাধ্য করিবার সেরা উপায় ভাতে মারা। আধার না থাকিলে রেশন মিলিবে না, গরিব মানুষের নিকট এহেন হুমকির বাড়া তাগিদ হয় না। রাষ্ট্র ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করিয়াছে— তবে, দারিদ্র বা ক্ষুধার বিরুদ্ধ লড়াইয়ে নহে, প্রত্যেক ভারতীয়কে আধার-এর আওতায় আনিবার জন্য। তাহাতে যদি এক বালিকার অনাহারে প্রাণ যায়, রাষ্ট্রের চোখের পাতা কাঁপিবে না। এবং, এই ‘অ-মানবিক’ রাষ্ট্র যাঁহাদের ভরসায় চলে, তাঁহারাও ক্রমে যন্ত্র হইয়া উঠেন। স্থানীয় রেশন আধিকারিক হইতে ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিসার অথবা অন্যান্য আধিকারিকরাও ‘আধার না থাকিলে রেশন মিলিবে না’, এই নিয়মটিকে ‘স্বাভাবিক’ বলিয়া মানিয়া লইয়াছেন। কেহ প্রতিবাদ করেন নাই। একটি হতদরিদ্র মেয়ের প্রাণের দাম কি কর্তাদের ইচ্ছার অধিক হইতে পারে?