আসুন, রক্ষা করি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে

সময় বদলাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে চেনা পৃথিবীটা। এখনকার ছেলেমেয়েরা আর শুধুই নির্মল আনন্দের জগতে বাস করে না। ছোট থেকেই হরেক রকম চাপ নিতে হয় তাদের। লিখছেন শালিনী ভট্টাচার্যসময় বদলাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে চেনা পৃথিবীটা। এখনকার ছেলেমেয়েরা আর শুধুই নির্মল আনন্দের জগতে বাস করে না। ছোট থেকেই হরেক রকম চাপ নিতে হয় তাদের।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০১৯ ০৩:৪৭
Share:

ঝরে গেল চোদ্দো বছরের একটি প্রাণ। রেখে গেল অনেক প্রশ্ন। চলে গেল নিঃশব্দে। কিন্তু তৈরি করে গেল আলোড়ন। ছোট্ট মেয়ে। আদুরে মেয়ে। বইপাগল মেয়ে। কী আশ্চর্য! কেউ তার আশ্রয় হতে পারল না? বাবা নয়। মা নয়। বইও নয়! এ ঘটনা কলকাতার। ঘটনাস্থল কলকাতার নামী একটি বেসরকারি স্কুল।

Advertisement

আসুন, আরও একটি ঘটনার কথা আপনাদের শোনাই। কিছু দিন আগে মুর্শিদাবাদের এক স্কুলছাত্রী আত্মহত্যা করে। বয়স বারো কি তেরো। গরিব ঘরের মেয়ে। স্কুলের সমস্ত অনুষ্ঠানে সে যোগ দিত। খুব ভাল ছিল না কোনও কিছুতেই। কিন্তু উৎসাহ ছিল অসীম। খুব কথা বলত। হাসত। স্কুলে, তার পাড়ায়, তার গ্রামে সবাই তাকে খুব ভালবাসত।

কলকাতার মেয়েটির নামী স্কুল। সেখানে সিক-রুম আছে। অসুস্থ বোধ করায় মেয়েটি সিক-রুমের উদ্দেশে রওনা দেয়। কিন্তু সেখানে না গিয়ে সোজা চলে যায় শৌচালয়ে। সেখানেই আত্মহনন করে। আর মুর্শিদাবাদের মেয়েটি কীটনাশক খায় বাড়িতে। কীটনাশক খাওয়ার পরে সে খুব শান্ত ভাবে সবাইকে জানিয়ে দেয় যে, সে বিষ খেয়েছে। তাকে যেন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া না হয়। তাকে যেন শান্তিতে মরতে দেওয়া হয়। কলকাতার মেয়েটি তিন পাতার সুইসাইড নোট রেখে যায়।

Advertisement

মুর্শিদাবাদের মেয়েটি হঠাৎ চুপ করে যায়। মাঝে মাঝেই সে চমকে উঠত। বলত, সে খুব ভয় পায়। ছায়ার মতো কেউ বা কারা যেন তাকে ধরতে আসে। সে মরে গেলে এদের হাত থেকে মুক্তি পাবে। পুলিশ জানিয়েছে, কলকাতার মেয়েটি ছোট থেকেই আত্মহত্যাপ্রবণ ছিল। কলকাতার মেয়েটির স্কুলের তরফে জানানো হয়েছে, তাদের এ কথা জানানো হয়নি। কী করে জানাবেন অভিভাবকেরা? জানালে নামী স্কুল এমন ছাত্রীকে ভর্তি নেবে? কোন সাহসে বাবা-মা এ সব গোপন কথা প্রকাশ করবেন? মানসিক ও শারীরিক ভাবে অসুস্থ ছাত্রছাত্রীদের বেসরকারি স্কুলগুলো সর্বদাই এড়িয়ে চলতে চায়। তাই অভিভাবকেরা তো মুখে কুলুপ আঁটবেনই। আর গাঁ-গঞ্জের বহু লোকজন আজও এই মানসিক অসুস্থতার বিষয়টিই বোঝে না।

কলকাতার মেয়েটির কথা তবুও তো খবরের কাগজের প্রথম পাতায় স্থান পায়। কিন্তু গরিব পরিবারের কত প্রাণ অসময়ে ঝরে যায়। কে তার খবর রাখে! পুলিশ জানিয়েছে, কলকাতার মেয়েটির লেখা পড়ে বোঝা যাচ্ছে যে, কোনও ঘটনার আতঙ্ক তাকে তাড়া করে বেড়াত। মুর্শিদাবাদের মেয়েটিও ভয় পেত। কিসের ভয়? নাকি এই ভয় অসুস্থ মনের অলীক কল্পনা? কে বলবে? কার কাছে আছে এ সব প্রশ্নের উত্তর?

শহরের বাবা-মায়ের সচেতনতা আছে। কিন্তু সময় নেই। গ্রামের মানুষের সময় আছে। সে ভাবে সচেতনতা নেই। বয়ঃসন্ধির সময় এমনিতেই ছেলেমেয়েরা মানসিক ভাবে কিছুটা বিপন্ন থাকে। তাদের মধ্যে নানা রকম পরিবর্তন আসে। এ সময় সন্তানদের চোখে চোখে রাখতে হয়। নানা রকম বিপদ সম্পর্কে তাদের সচেতন করতে হয়। তাদের ভালবাসার সঙ্গে সঙ্গে তাদের বন্ধু হয়ে উঠতে হয়। বিভিন্ন বিষয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে হয়। শুনতে হয় তাদের সমস্যার কথা, অস্বস্তির কথা।

সময় বদলাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে চেনা পৃথিবীটা। এখনকার ছেলেমেয়েরা আর নির্মল আনন্দের জগতে বাস করে না। ছোট থেকেই হরেক রকম চাপ নিতে হয় তাদের। হারিয়ে যাচ্ছে খেলার মাঠ, পাড়ার বন্ধু-বান্ধব। তাদের নিজেদের আর কোনও জগৎ নেই। গ্রামে-গঞ্জেও এখন শিশুরা খেলার থেকে বেশি সময় কাটায় টিভি দেখে। একান্নবর্তী পরিবার নেই। নেই সমবয়সী বা প্রায় সমবয়সী একদল ছেলেমেয়ের সঙ্গে বড় হয়ে ওঠা। নেই পাড়াতুতো বন্ধু-বান্ধব। নেই নির্ভার জীবন, সুদীর্ঘ অবসর। নেই-এর তালিকা যত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে ততই তীব্র হচ্ছে নিঃসঙ্গতা। জাঁকিয়ে বসছে অবসাদ।

পুলিশের মতে, কলকাতার মেয়েটির শেষ চিঠির ছত্রে ছত্রে অবসাদ। মুর্শিদাবাদের মেয়েটিরও অবুঝ জিজ্ঞাসা ছিল, মৃত্যুর পরে মানুষের সব দুঃখ কষ্টের অবসান হয় কি না? অবসাদ থেকে আসে বিষাদ, আত্মহত্যার প্রবণতা। তাদের দুঃখকষ্ট কী তা জানতে হবে অভিভাবককে, শিক্ষককে, সমাজকে। তবে তো বাঁচবে অমূল্য প্রাণগুলি।

কারা আত্মহত্যাপ্রবণ? কারা অবসাদগ্রস্ত? শ্রেণিকক্ষের প্রায় একশো ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কী ভাবে চিহ্নিত করা যাবে তাদের? সরকারি উদ্যোগে কর্মশালার মাধ্যমে প্রতিটি বিদ্যালয়ের দু’-এক জন শিক্ষক-শিক্ষিকাকে এ বিষয়ে সচেতন করা যেতে পারে। তারা আবার ‘মাতা শিক্ষক কমিটি’র মিটিংয়ে যদি সহজ-সরল ভাবে বিষয়টি আলোচনা করেন তা হলে কিছুটা কাজ হতে পারে। এর সঙ্গে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে এ জাতীয় বিষয়গুলো নিয়ে নিয়মিত আলোচনার আয়োজন করতে হবে। বারবার একই কথা শুনতে শুনতে মানুষ কিছুটা হলেও সন্তানদের বিপন্নতা সম্পর্কে সচেতন হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৭ সালে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয় যে, সমস্ত দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মধ্যে ভারতবর্ষে আত্মহত্যার হার সবথেকে বেশি। ভারতের তেরো থেকে পনেরো বছর বয়সী প্রতি চার জন কিশোর-কিশোরীর মধ্যে এক জন অবসাদে ভোগে। ২০১৫ সালে WHO-এর স্লোগান ছিল—‘Depression— Let's talk.’ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, অবসাদ সম্পর্কে খোলাখুলি আলোচনা ও তার লক্ষণগুলো সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে। তবেই অবসাদগ্রস্ত রোগীরা সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা পাবে। অবসাদ মানসিক রোগ। সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে যার নিরাময় সম্ভব। অবসাদ নিঃশব্দে একটি মহীরূহতে পরিণত হয়েছে। সময় এসেছে একে নির্মূল করার। আসুন, আর কোনও প্রাণ অকালে ঝরে যাওয়ার আগে আমরা সচেতন হই। অন্যদের সচেতন করি। রক্ষা করি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে।

শিক্ষিকা, নওপুকুরিয়া জানকীনাথ যদুনাথ উচ্চ বিদ্যালয়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement