Yogi Aditynath

বুলডোজার রাজ: বিচারের নামে প্রহসন, শাসনের নামে আগ্রাসন

বুঝতে অসুবিধে নেই, এই বুলডোজার ভারতের সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে বিপন্ন সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য বাছাই করে প্রয়োগ করা হচ্ছে।

Advertisement

দীপঙ্কর ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০২২ ১২:৪৭
Share:

এনকাউন্টার এবং বুলডোজার— যোগী শাসনের দুই পরিচিত হাতিয়ার। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

যখনই কোনও অপ্রিয় বাস্তবের সঙ্গে ওদের মুখোমুখি হয়, ওরা বুলডোজার দিয়ে তাকে গুঁড়িয়ে দেয়। ঐতিহাসিক ইলাহাবাদ শহরে কয়েকদিন আগে যোগী আদিত্যনাথের বুলডোজার যখন জাভেদ মহম্মদের বাড়িটি গুঁড়িয়ে দিচ্ছিল, তখন ২০ বছর আগে লেখা প্যালেস্টাইনের কবি মাহমুদ দারবিশের লাইনটা আবার মনে পড়ে গেল।

Advertisement

দারবিশের সেই দীর্ঘ কবিতার শেষে তিনি লিখেছিলেন, কলমের আঁচড় এখন রক্তহীন ক্ষত। বুলডোজার নিয়ে লেখা মানে সেই রক্তহীন ক্ষতের জবানবন্দি।

বছর কয়েক আগে বিহারের গ্রামে নীতীশ কুমারের স্বঘোষিত সুশাসন-রাজে বুলডোজার দিয়ে গরিবের ঝুপড়ি ভেঙে দেওয়ার ছবি দেখেছিলাম। জেনেছিলাম, জলাশয় পুনরুদ্ধার ও সবুজায়নের ঢাক পেটানো ‘জল, জীবন, হরিয়ালি’ প্রকল্পের নামে এই ধ্বংসলীলা চলছে। গণপ্রতিবাদের জোরে গরিব মানুষ অনেক জায়গাতেই সেই বুলডোজারকে বিহারের গ্রামে ঠেকিয়ে দিয়েছেন। উত্তরপ্রদেশ এবং মধ্যপ্রদেশে যে বুলডোজার অভিযান আজ চলছে, তার মাত্রা ও চরিত্র কিন্তু অন্য রকমের।

Advertisement

উত্তরপ্রদেশে এবারের নির্বাচনে বিজেপির পক্ষ থেকেই যোগী আদিত্যনাথের নতুন ভাবমূর্তি তুলে ধরা হয়েছিল— ‘বুলডোজার বাবা’। নির্বাচনে জেতার পর বিজয়মিছিল হিসেবে আমরা দেখেছি ‘বুলডোজার মার্চ’। বুলডোজার আজ উত্তরপ্রদেশে বিজেপির শাসনক্ষমতার প্রতীক। উত্তরপ্রদেশে এ বারের নির্বাচন জেতার পর বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপি নেতা ও মন্ত্রীদের আমরা আদিত্যনাথের আদলে রাজ্যে রাজ্যে শাসনের বুলডোজার মডেল চালু করার দাবি করতে শুনছি।

বুলডোজার দিয়ে ভেঙে ফেলা হচ্ছে একের পর এক বাড়ি।

এনকাউন্টার এবং বুলডোজার— যোগী শাসনের দুই পরিচিত হাতিয়ার। অভিযুক্তকে আইনের হাতে তুলে দিয়ে আইনি প্রক্রিয়া অনুযায়ী বিচারব্যবস্থাকে চলতে দেওয়ার বদলে নতুন ‘স্মার্ট’ বিচারপদ্ধতি হল অভিযুক্তকে সরাসরি ‘অপরাধী’ হিসেবে চিহ্নিত করে এনকাউন্টারের গল্প সাজিয়ে তাকে উড়িয়ে দেওয়া। উত্তরপ্রদেশের আজকের এই পদ্ধতি এক যুগ আগে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের আমলে পশ্চিমবঙ্গ প্রত্যক্ষ করেছিল, অতীতে অন্ধ্রপ্রদেশ ও ছত্তীসগড়েও এর ব্যাপক প্রয়োগ দেখা গেছে। আর বর্তমানে দেখা যাচ্ছে অসমে।

অন্য রাজ্যের সঙ্গে উত্তরপ্রদেশ মডেলের তফাত হল উত্তরপ্রদেশে বুক ফুলিয়ে সরকার এনকাউন্টার করে এবং এনকাউন্টারের পরিসংখ্যান দিয়ে শাসনের সার্থকতার কাহিনি প্রচারিত হয়। বুলডোজারের ব্যবহারও একই ভাবে করা হচ্ছে। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে, ভীতি উৎপাদন ও প্রদর্শনের মাধ্যম হিসেবে। এনকাউন্টারের জন্য যেমন একটি ‘ন্যারেটিভ’ সাজাতে হয়, সেই বাধ্যবাধকতাটুকু এখনও বুলডোজারের জন্যও রয়ে গেছে। বুলডোজার চালানোর জন্য নিশানা ঠিক হতেই সংশ্লিষ্ট কর্পোরেশন বা মিউনিসিপ্যালিটির কাজ হল ‘ব্যাকডেটে’ একটি নোটিস লটকে দেওয়া। মধ্যপ্রদেশের খারগোন থেকে উত্তরপ্রদেশের এলাহাবাদ, থুড়ি প্রয়াগরাজ, সর্বত্রই একই পদ্ধতির ব্যবহার দেখা গিয়েছে।

এই পদ্ধতির ফাঁকফোকরও সহজেই নজরে আসছে। জেলা প্রশাসন বা মিউনিসিপ্যালিটির কাছে আরটিআই আর্জি দাখিল করলেই সে সব ফাঁক বেরিয়ে আসছে। তথ্যের মুখোশ খুলে বেরিয়ে পড়ছে জলজ্যান্ত মিথ্যার আসল চেহারা। এলাহাবাদে আফরিন ফতিমার বাড়িটি মা পরভিন ফতিমার নামে। কিন্তু ‘ব্যাকডেটেড নোটিস’ এসেছে আফরিনের বাবা জাভেদ মহম্মদের নামে। বছরের পর বছর ধরে বাড়ির জন্য পুরকর জমা পড়েছে, হঠাৎ করে এমন কী অবৈধ নির্মাণ আবিষ্কার হল, যার জন্য সেই বাড়িটিকে গুঁড়িয়ে দিতে হবে? দু’দিনের নোটিসে রাতারাতি বাড়ি ভেঙে দেওয়ার অধিকার কোন আইনের বলে?

কড়া শাস্তি দিতে কি বাড়ি ভেঙে ফেলা হচ্ছে?

এই সমস্ত প্রশ্নই অত্যন্ত জ্বলন্ত। কিন্তু সবচেয়ে জ্বলন্ত বিষয়টি হল এই বুলডোজার অভিযানের মুসলিম-বিদ্বেষী নিশানা । যদি ধরে নেওয়া হয়, ভারতীয় রাষ্ট্র কড়া হাতে আন্দোলন বা প্রতিবাদ দমনের জন্য এই স্বৈরতান্ত্রিক বুলডোজার-নীতি গ্রহণ করেছে, তা হলে ‘পদ্মাবত’ সিনেমার বিরুদ্ধে কর্নি সেনার উগ্র হিংসাত্মক আন্দোলনের সময় কেন এই নীতি প্রয়োগ করা হয় না? সবরিমালা মন্দিরে মহিলাদের প্রবেশ সংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের রায় বা সংরক্ষণের প্রশ্নে উগ্র আন্দোলনের সময় কেন এই বুলডোজার ব্যবহার হয় না? বুঝতে অসুবিধে নেই, এই বুলডোজার ভারতের সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে বিপন্ন সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য বাছাই করে প্রয়োগ করা হচ্ছে। বাবরি মসজিদ ভাঙা থেকে পুলিশ নামিয়ে বুলডোজার দিয়ে মুসলিম নাগরিকদের ঘর গুঁড়িয়ে দেওয়া— গত তিন দশকে ভারতের রাষ্ট্রচরিত্রের চলমান বিবর্তনের এ এক সুস্পষ্ট চালচিত্র।

বুলডোজার শুধু বিচারের নামে প্রহসন নয়, বুলডোজার আজ ভারতের শাসনব্যবস্থার নতুন উদ্ধত প্রতীক। এ যেন সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লিখিত ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রে সমস্ত নাগরিকের জন্য স্বাধীনতা, সাম্য, সৌভ্রাতৃত্ব এবং সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক ন্যায়ের প্রতিশ্রুতিকে পদদলিত করে রাষ্ট্রক্ষমতার নতুন রথ। নতুন সিংহাসন। পাঠকদের নিশ্চয়ই স্মরণে আছে, কিছু দিন আগে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ভারত সফরে এসে গুজরাতের জেসিবি বুলডোজার কারখানা পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। বুলডোজারে বসে তাঁর সগর্ব সহাস্য ছবিটিও নিশ্চয়ই আমাদের স্মরণে আছে।

আমার কাছে সেই ছবিটি ভীষণ প্রতীকী এবং তাৎপর্যপূর্ণ।

ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনই ছিল প্রথম বুলডোজারের রাজত্ব। তখন হয়তো আজকের এই মাটি-খোঁড়া বা ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে-দেওয়া জেসিবি মেশিন ছিল না। কিন্তু ভারতবাসীর স্বাধীনতাস্পৃহা, সমস্ত মানসম্মান ও অধিকারকে দাবিয়ে রাখার এবং গুঁড়িয়ে দেওয়ার আগ্রাসী ঔদ্ধত্য নিয়েই ইংরেজ এ দেশে রাজত্ব করেছে। জেসিবি একটি ব্রিটিশ কোম্পানি। পুরো নাম ‘জে সি ব্যামফোর্ড এক্সক্যাভেটর্স’। তার ভারতীয় শাখাতেই আজ ভারতের অধিকাংশ বুলডোজার তৈরি হয়। বরিস জনসনের ছবিটা দেখে মনে হয়েছিল, আদত ‘বুলডোজার রাজ’-এর ব্র্যান্ডদূত ভারতে এসে আজকের উত্তর-ঔপনিবেশিক বুলডোজার রাজকে শংসাপত্র দিয়ে গেলেন।

হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ‘মাউন্টব্যাটেন মঙ্গলকাব্য’ মনে আছে? ‘মাউন্টব্যাটন সাহেব ও/ তোমার সাধের ব্যাটন কার হাতে/ থুইয়া গেলা ও।’ আজকের এই বুলডোজার রাজের পর্যায়ে নতুন বুলডোজার ব্যালাড লেখার সময় এসেছে— ‘ওয়ারেন হেস্টিংস সাহেব ও/ তোমার সাধের বুলডোজার কার হাতে/ থুইয়া গেলা ও...।’

(লেখক সিপিআই (এমএল) লিবারেশনের সাধারণ সম্পাদক। মতামত নিজস্ব)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তেফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement