পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি বিজেপি কর্মীদের। —নিজস্ব চিত্র
চরম লজ্জার মুখোমুখি হল গণতন্ত্র। দিনভর যা চলল বনগাঁয়, তার চেয়ে বড় অন্যায় গণতন্ত্রের সঙ্গে ক’বার ঘটেছে এ দেশে, বলা কঠিন। পুরসভার চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আসা অনাস্থা প্রস্তাবকে ঘিরে শাসক ও বিরোধীর জঘন্য টানাপড়েনে গণতন্ত্রকে নিয়ে যে ‘ছেলেখেলা’ হল, তার জুড়ি মেলা ভার।
বনগাঁ পুরসভায় তৃণমূলের অধিকাংশ কাউন্সিলর দল ছেড়ে শামিল হয়েছেন বিজেপি-তে। পুরসভায় এখন তৃণমূল সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে বলে বিজেপি দাবি করছে অতএব। তৃণমূলের পাল্টা দাবি, গরিষ্ঠতা এখনও চেয়ারম্যানের সঙ্গেই। গরিষ্ঠতা আসলে কোন দিকে, তা প্রমাণ করার দিন ছিল মঙ্গল বার। কিন্তু সেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার নামে গণতন্ত্রের যে মারাত্মক প্রহসন মঞ্চস্থ হল বনগাঁয়, এই রাজ্য কেন, এই দেশের কোনও প্রান্তে একটা পুরসভার দখল নিজেদের হাতে রাখতে পারার প্রশ্নকে ঘিরে এমন ঘটনা কোনও দিন ঘটেছে কি না, সহজে মনে করা যাচ্ছে না।
চেয়ারম্যানের বিপক্ষে থাকা কাউন্সিলরদের মধ্যে দু’জনকে প্রথমে আটকে দিল পুলিশ। তাঁদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা হয়েছে, তাই ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না, শোনা গেল এমনই। জামিন অযোগ্য ধারায় কারও বিরুদ্ধে মামলা হলে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করতে পারে। কিন্তু পুলিশ গ্রেফতার করেনি, আবার অনাস্থার ভোটাভুটিতেও পৌঁছতে দেয়নি। জামিন অযোগ্য ধারায় মামলার সঙ্গে অনাস্থার ভোটাভুটিতে অংশ নেওয়ার কী বিরোধ রয়েছে, সে ব্যাখ্যা কেউ কাউকে দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। পুলিশ কখনও জানিয়েছে, হাই কোর্ট থেকে ওই কাউন্সিলররা যে আগাম জামিন পেয়েছেন, তার লিখিত নথি এনে দেখাতে হবে। কখনও তৃণমূল সমর্থকরা তেড়ে গিয়েছেন বিজেপি কর্মীদের দিকে। কখনও বিজেপি কর্মীরা পাল্টা বিক্ষোভ শুরু করেছেন। কখনও তৃণমূল দাবি করেছে, অনাস্থা প্রমাণ করা যায়নি। কখনও বিজেপি পাল্টা দাবি করেছে অনাস্থা প্রমাণিত হয়েছে। কখনও বোমাবাজি-ভাঙচুর হয়েছে পুরসভা সংলগ্ন এলাকায়। কখনও পুলিশ লাঠি চালিয়েছে। দিনের শেষে দু’পক্ষই দাবি করেছে, জয়ী হয়েছেন তাঁরাই। অতএব আসলে জয়টা কার হল বোঝা না গেলেও চূড়ান্ত পরাজয়টা যে গণতন্ত্রেরই হয়েছে, তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
আরও পড়ুন: অনাস্থা ভোট ঘিরে বোমা-ভাঙচুরে অগ্নিগর্ভ বনগাঁ, আমরাই জিতেছি, দাবি তৃণমূল-বিজেপি দু’পক্ষেরই
এই জঘন্য এবং লজ্জাজনক কাণ্ড যাঁরা ঘটালেন, তাঁরা কতটা লজ্জিত বোধ করছেন, জানি না। নাগরিক হিসেবে আমরা অপরিমেয় লজ্জার সম্মুখীন হয়েছি আমাদের সাধের গণতন্ত্রের এই অভাবনীয় পরিণতি দেখে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটাকে মজবুত রাখার দায়িত্ব কিন্তু সব রাজনৈতিক দলেরই। দায়িত্বটা প্রশাসনেরও। কিন্তু কেউ সে দায়িত্ব পালন করতে পারলেন না বনগাঁয়। গণতন্ত্র চরম হেনস্থা ও অন্যায়ের সম্মুখীন হল। এই অন্যায়ের বিচার উপযুক্ত প্রতিষ্ঠানেই হবে বলে আশা করা যায়। কিন্তু আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, সব প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বে কিন্তু আর একটা দরবার রয়েছে— সে হল জনতার দরবার। জনতা সব দেখছে, সব হিসেব রাখছে। চূড়ান্ত বিচারটা কিন্তু সেই দরবারেই হবে। আপাতত সেই অমোঘ বিচারের প্রতীক্ষা চলুক। আর এই দিনটা অন্যায়ের দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাক।