ছবি: সংগৃহীত
বহুগুণ বেশি আসন পাওয়া দলনেতাকে অভিনন্দন জানাইতে গিয়াও স্বভাবজ স্পর্ধাভাষণ আটকাইতে পারিলেন না পরাভূত দলের দিল্লি শাখার প্রধান। বলিলেন, তিনি আশা করিবেন, ক্ষমতায় আসিয়া আপ মুখ্যমন্ত্রী জনতার প্রত্যাশার মান রাখিবেন। মন্তব্যটি বুঝাইয়া দেয়, ভারতীয় জনতা পার্টির সমস্যা কোথায়। দলের এমন বিষম পরাজয়ের পরও দলপ্রধান বুঝিতে নারাজ যে, দ্বিতীয় দফার শাসনে মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবাল জনতার ‘প্রত্যাশার মান’ রাখিয়াছিলেন বলিয়াই তৃতীয় বার তিনি এত বড় ব্যবধানে জয়ী হইতে পারিলেন। বাস্তবিক, এই জয় মুখের কথা নহে। বর্তমান হিংসাবিধ্বস্ত ও সংঘর্ষ-ত্রস্ত দেশের রাজধানীতে স্বঘোষিত ‘হিন্দু হৃদয়সম্রাট’কে এই ভাবে হারাইয়া, বলা ভাল, পর্যুদস্ত করিয়া, অরবিন্দ কেজরীবাল নিজের আসন অটুট রাখিলেন। ইহাও লক্ষণীয়, নির্বাচন-পর্বের আগাগোড়া তাঁহার ও তাঁহার দলের মধ্যে এক অবিচলিত আত্মপ্রত্যয় দেখা গিয়াছিল। দিল্লিতেও ইহাই ছিল কানাঘুষা, সমগ্র দেশের জনমানসেও বিশেষ সংশয় ছিল না যে, এই বারও রাজধানীর দখল রাখিবে আপ-ই। অর্থাৎ, আপ-এর এই বিরাট জয় সম্পূর্ণত প্রত্যাশিত এবং প্রতীক্ষিত একটি ঘটনা। শাহিন বাগ-পর্বে নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহের কট্টরপন্থী উগ্রবাদী নির্বাচনী প্রচার ও প্রভূত বিদ্বেষবিষ বর্ষণও কিন্তু সেই প্রত্যাশা ও প্রতীক্ষার উপর শীতল হতাশাবারি সেচন করিতে পারে নাই। এই সমস্ত কিছু সম্ভব হইল একটিই কারণে— কেজরীবালের শাসন-নৈপুণ্য। গত পাঁচ বৎসর তিনি অখণ্ড মনোযোগে এবং বিরাট সাফল্যের সহিত প্রশাসনিক হালটি ঠিক রাখিয়াছেন, এবং সেই প্রশাসনিক সাফল্যই এই নির্বাচনের ফল গড়িয়া দিয়াছে। বিবিধ প্রচারদুন্দুভি এবং সমাজমাধ্যমের হুঙ্কারকে অগ্রাহ্য করিয়া একনিষ্ঠ ভাবে কাজ করিয়াছেন বলিয়াই সম্ভবত জনসাধারণ তাহার ‘মান’ না রাখিয়া পারেন নাই। এবং, সেই প্রেক্ষিতেই, কেজরীবালের প্রতি মনোজ তিওয়ারির উল্লিখিত বার্তাটি এত স্পর্ধিত।
স্পর্ধা সত্যই অসীম। এই বারের দিল্লি নির্বাচন আরও বেশি করিয়া বুঝাইয়া দিল, বিজেপি নিজের রাজনীতির মধ্যে কিন্তু কাজ কিংবা প্রশাসনের নামগন্ধ রাখিতে উৎসুক নহে। তাহার লক্ষ্য, একটি অন্য রকম রাজনীতি, যাহাকে বলা যায় সংখ্যাগুরুবাদের প্রাবল্যের রাজনীতি। সেই রাজনীতির নিকট মানুষের দৈনন্দিন সমস্যার যোগ নেহাত সামান্য। স্বাধীনতার পর দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি একনাগাড়ে এতখানি টালমাটাল আর কখনও হয় নাই। অথচ, কেন্দ্রীয় শাসক হিসাবে, এবং দিল্লির বিরোধী হিসাবে বিজেপির রাজনীতি আবর্তিত হইয়াছে কেবল সংখ্যালঘু নামক একটি অতিসরলীকৃত ও আতিশয্যলাঞ্ছিত ‘সঙ্কট’ লইয়া। দিল্লিতে আপ যদি আবার ক্ষমতায় আসে, ভারত তবে ‘পাকিস্তান’ হইয়া যাইবে, এমন একটি ভিত্তিহীন অন্যায় দাবি জনমানসে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হইয়াছে। প্রকৃতপক্ষে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে যে গোত্রের ঘৃণাকলঙ্কিত হিংসা-অধ্যুষিত প্রচার এ বার দেখা গিয়াছে, বিজেপির নিজস্ব মাপকাঠিতেই তাহা অভূতপূর্ব। এই কদর্য রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হয়তো একেবারে বৃথাও যায় নাই। বিজেপি আগের বারের দিল্লি বিধানসভা ভোট অপেক্ষা আসন দ্বিগুণ করিয়াছে। তবু মনোজ তিওয়ারিদের শ্রমের তুলনায় ফললাভ সামান্যই। আসনসংখ্যার বিরাট ব্যবধানকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হয়। এই ব্যবধান সম্ভবত বৃহত্তর ভারতের জনসমাজ বিষয়েও একটি বার্তা দেয়। আস্ফালন এবং কুৎসার রাজনীতির বিপুল পরাভবের প্রতীকে ধরা থাকে একটি আশার কথা যে, একনিষ্ঠ ও বুদ্ধিদীপ্ত চেষ্টা করিলে, কর্মের রাজনীতি ধর্মের নামে অধর্মরঞ্জিত রাজনীতির উপরে উঠিতে পারে। অন্যান্য অঞ্চলের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন রাজনীতিকেরা শিক্ষাটি গ্রহণ করিবেন কি?