ছবি পিটিআই।
রাজনীতি কি আইডেন্টিটি লইয়া নাজেহাল, না কি আইডেন্টিটি বিষয়টিই আজিকার রাজনীতির ধাক্কায় ঘায়েল? ভাবিবার কথা বটে। এই মুহূর্তে ভারতীয় জনতা পার্টি পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন উপলক্ষে বাঙালি আইডেন্টিটির রহস্যভেদে যখন আদাজল খাইয়া ঝাঁপাইয়া পড়িতেছে, তখন মনে হইতে পারে প্রথম বাক্যটিই সিলমোহরযোগ্য। কী করিবেন রাজনীতিকরা, তাঁহাদের তো এই পথেই মানুষের কাছে আসিতে হইবে! কিন্তু আবার, অধুনা বাংলা ও বাঙালির ‘কাছে আসিবার’ সাধনায় বিজেপি নেতারা প্রত্যহ যে সব কাণ্ড করিতেছেন, তাহাতে আইডেন্টিটি বা সত্তা-পরিচিতির এক বিষম দুর্বিপাক উপস্থিত। ‘রবীন্দ্রনাথ টেগোর’-কে বাঙালি স্পর্ধাবশত ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ বলে— এহেন মন্তব্য নেতৃমুখে প্রকাশ্যে শুনিবার পর বাঙালি আইডেন্টিটির পক্ষে ধরণীকে দ্বিধা হইতে বলা ভিন্ন গতি থাকে না। তাহারই আপন ভূমিতে আসিয়া, তাহাকে বিন্দুমাত্র না জানিয়া-চিনিয়া, অশিক্ষা ও অসংস্কৃতির স্পর্ধা যে তাহাকে বাগ মানানোর এই কুৎসিত প্রয়াস করিতে পারে— তাহাতে বিস্মিত নহে, কুপিত হইতে হয়। অ-জ্ঞানতা অপরাধ নহে, অনেক নেতানেত্রীই রাজনীতির কারণে অন্যের সম্পর্কে নিজের অজ্ঞানতা দূরীকরণের সাধনায় নামেন। বিশেষ করিয়া বৃহৎ দেশের অপরাপর অঞ্চলের মানুষরা বাংলায় আসিয়া বাঙালি-সান্নিধ্যলাভের জন্য ভাষা-সংস্কৃতি চর্চা করিয়াছেন বহু কাল ধরিয়া। বাঙালিও বহু কাল ধরিয়া তাহাতে প্রফুল্ল ও সম্মানিত বোধ করিয়া আসিয়াছে। কিন্তু এখন বিজেপির বাংলা-চর্চা তাহাকে বিরক্ত করিতেছে, কেননা অপরকে হেয়চোখে দেখিবার, সংস্কৃতি-চর্চার নামে ক্যারিকেচার প্রকল্পের মধ্যে যে গভীরপ্রোথিত অশ্রদ্ধা— ইহা সহ্য করা মুশকিল। নব্য-বাংলা-উৎসাহী নেতারা বুঝিতেছেন কি, তাঁহারা নিজেদের হিতের বদলে বিপরীত ডাকিয়া আনিতেছেন? বাংলা প্রবাদটি তাঁহারা ইতিমধ্যে শুনিয়াছেন কি: ফাঁকি দিয়া মহৎ কার্য সাধন হয় না?
অমিত শাহেরা নিশ্চয় বুঝিতে পারিতেছেন, বাঙালির ক্ষেত্রে একটি বিষম মুশকিল আছে। তাহার ভাষা কেবল মুখের কথার ভাষা নহে, সাহিত্য সঙ্গীত নাটক চলচ্চিত্র নানা ক্ষেত্রের নানা অনুষঙ্গে সেই ভাষা আপাদমস্তক জারিত। সব ভাষাতেই কিছু কবি-সাহিত্যিক আছেন, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি আছেন, কিন্তু যে কোনও ভাষায় রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দ সুভাষচন্দ্ররা নাই। অনেক দিন আগে কবি-প্রাবন্ধিক বুদ্ধদেব বসু আলোচনাসূত্রে বলিয়াছিলেন, রবীন্দ্রনাথের বিশেষত্ব ইহা যে, তিনি যে ভাবে বাঙালির সামগ্রিকতা জুড়িয়া বিরাজ করেন, তেমন দৃষ্টান্ত কেবল আর এক জনই আর এক সংস্কৃতিতে পাইয়াছেন: জার্মান ভাষায় গ্যোয়ঠে। এমন একটি ‘ইউনিক’ ভাষাসমাজের সামনে দাঁড়াইয়া ফাঁকতালের উদ্ধৃতিতে কাজ হইবে কেন।
তবে কি বিজেপি ‘বহিরাগত’ বলিয়া এই সঙ্কট? এমন সিদ্ধান্তও অতিসরল হইবে। উদ্দেশ্য ও বিধেয় বিচারে বিজেপি এই সমাজের নানা অঙ্গনে প্রোথিত। তবে সমস্যা এইখানেই যে, ‘বহিরাগত’ হইলেন বিজেপির উচ্চকোটির নেতৃত্ব। নূতন করিয়া তাই আজ নেতৃত্বের খোঁজ পড়িয়াছে, এবং সেই কারণেই বাংলার সাংস্কৃতিক দুনিয়াতেও মত্তহস্তীর দাপট শুরু হইয়াছে। বিশ্বভারতীর সাম্প্রতিক গোলযোগকে এই দর্পণেই দেখিতে হইবে। ক্রমে সাহিত্য, নাটক কিংবা চলচ্চিত্র মহলও নব্যতন্ত্রের হস্তক্ষেপ অনুভব করিবে, এই আশঙ্কাও উড়াইয়া দেওয়া যায় না। বাংলার সাংস্কৃতিক আকাশে এখন তাই রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার ঘোরকৃষ্ণমেঘ। তবে কিনা, ইতিহাস বলিতেছে, বাংলার রাজনীতিতে ‘বহিরাগত’ নেতৃত্ব কোনও কালে বাঙালির মঙ্গল ঘটাইতে পারে নাই, এবং বাঙালি সংস্কৃতির মাটিতে কোনও রাজনৈতিক নব্য-নেতৃত্ব ভাল করিয়া পা রাখিতে পারে নাই। সুতরাং রণক্ষেত্র দুর্গম, যুদ্ধ দুরূহ।