ছবি পিটিআই।
অমিত শাহ স্বরূপে ফিরিলেন। রাজনীতি ফিরিল রাজনীতিতে। এত দিন যাহা আড়াল-আবডাল দিয়া চলিতেছিল, মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্পষ্ট ভাষায় তাহা বলিলেন। পশ্চিমবঙ্গের প্রতি বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের সাম্প্রতিক মনোভাব যে কতটাই ঔপনিবেশিক, কতটাই যে তাহার উপেক্ষা এবং অবজ্ঞা, তাহা ধ্বনিত হইল অমিত শাহের মুখে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করোনাভাইরাস লইয়া রাজনীতি করিতেছেন কি না, তাহা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার যে পদে পদে পশ্চিমবঙ্গকে রাজনীতির অস্ত্রে বিদ্ধ করিবার চেষ্টা করিতেছে, সে কথা ইতিমধ্যে সংশয়াতীত। উপর্যুপরি করোনাভাইরাস ও আমপান দুর্যোগের পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্কট আপাতত যত গভীর ও ব্যাপক হইবে, ততই তাহাকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের ব্যর্থতা বলিয়া দেখানো যাইবে। তাই অমিত শাহ যাহা বলিলেন, তাহা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপযোগী দায়িত্ববান কোনও বক্তব্য নহে, পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের দোরগোড়ায় দাঁড়াইয়া রাজ্যের বিরোধী দলের মুখপাত্রের ভোটপ্রচার। প্রতিফলিত হইল মোদী সরকারের অতিপরিচিত প্রকৃতিগত প্রবণতাটিও: নিজেদের ভ্রান্তি, দুর্বলতা ও ব্যর্থতার দায় যেনতেনপ্রকারেণ অন্যের উপর চাপাইবার চেষ্টা। বস্তুত, আড়াই মাস স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অদর্শন এবং সাম্প্রতিক দর্শন দেখিয়া কেহ সিদ্ধান্ত করিতে পারেন যে সরকারের ত্রুটিপূর্ণ নীতি ও বিচ্যুতির দায় সামলাইতে এই বার মঞ্চে আবির্ভূত হইয়াছেন মন্ত্রিসভার সর্বাপেক্ষা আক্রমণাত্মক সদস্য: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
পরিযায়ী শ্রমিক বিষয়ে মন্তব্যই চিত্রটি স্পষ্ট করিয়া দেয়। এই মুহূর্তে দেশের করোনা সংক্রমণ যে ভয়াবহ ভাবে পাল্টাইতেছে তাহার মুখ্য দায় কেন্দ্রীয় সরকারের। প্রধানমন্ত্রী প্রথম লকডাউনের ঘোষণা করিবার সময় যদি পরিকল্পনা ও দূরদৃষ্টির কিছুমাত্র পরিচয় দিতেন— পরিস্থিতি হয়তো ভিন্ন হইত। দেশের বিভিন্ন স্থানে কর্মরত বহু লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফিরিবার বন্দোবস্ত হইল না, বাহিরেও যথার্থ আশ্রয়ের ব্যবস্থা হইল না, লকডাউন আসিয়া পড়িল। দুই মাস অতিবাহিত হইবার পর সেই লক্ষ লক্ষ শ্রমিকদের নিজ নিজ রাজ্যে ফিরানো হইল। সংক্রমণ বাড়িল। ‘করোনা এক্সপ্রেস’ নামক শব্দবন্ধ ব্যবহার নিশ্চয় অসংবেদনশীল। কিন্তু একা পশ্চিমবঙ্গের নহে, একাধিক রাজ্যের বিপন্নতা যে প্রবাসী শ্রমিকদের এই বিলম্বিত আগমনে বহুগুণ বাড়িয়াছে— সেই দায়ের প্রধান অংশ কেন্দ্রেরই। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ঘাড়ে দোষ চাপাইলেই কি সেই দায় কাটানো যাইবে?
অমিত শাহ দাবি করিলেন, ক্ষমতায় আসিলে ‘এক মিনিটের মধ্যে’ রাজ্যে প্রকল্প চালু করিয়া দরিদ্র মানুষের উপকার করিবেন। তাঁহার সদিচ্ছার উপর আস্থা রাখিতে অসুবিধা হইত না, যদি বিজেপি সরকার পশ্চিমবঙ্গকে আক্ষরিক অর্থে ভাতে মারিয়া না রাখিত। বুলবুল, আমপান, কোভিড-১৯, এই সকলেরও আগে দিল্লি হইতে এই রাজ্যের যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ‘অনাদায়ী’ হইয়া রহিয়াছে, উপর্যুপরি আবেদন-নিবেদনেও যে অর্ধ লক্ষ কোটি রাজ্যের কোষাগারে আসিতেছে না, তাহার পর এই অর্থসহায়তার গাজর দেখাইবার মধ্যে অতি নিকৃষ্ট রাজনীতি ছাড়া আর কিছুই নাই। বৎসরের আরম্ভ হইতে মুখ্যমন্ত্রী সেই প্রাপ্য অর্থের অন্তত কিছুটা দাবি করিয়া আসিতেছেন, এপ্রিলে লকডাউনের মধ্যেও তাহা যাচ্ঞা করিয়াছেন। অথচ আমপানের ভয়াবহ ধ্বংসলীলার পরও রাজ্যের ঝুলিতে জমা পড়িয়াছে মাত্র এক হাজার কোটি টাকার আশ্বাস। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অস্ত্রে তাঁহার প্রতিপক্ষ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কতখানি ঘায়েল হইলেন, তাহা সময়ই বলিবে। কিন্তু সর্বব্যাপী বিপর্যয়ের মধ্যে দাঁড়াইয়া কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর এই আক্রমণাত্মক অসহযোগিতা আপাতত বিপন্ন করিল যাহাকে, তাহার নাম পশ্চিমবঙ্গ।