বিহারে সর্বার্থে জয়ী একটিমাত্র দল। তাহার নাম ভারতীয় জনতা পার্টি। রাজ্যে এনডিএ-র প্রধান শরিক হইয়া উঠা; নীতীশ কুমারকে এমন ভাবে ছাঁটিয়া ফেলিতে পারা যাহাতে তাঁহার রাজনৈতিক অস্তিত্বটি বিজেপির উপর নির্ভরশীল হইয়া থাকে; লকডাউন-পরবর্তী আর্থিক সঙ্কট, বিশেষত পরিযায়ী শ্রমিক সঙ্কটের আঁচ দলের ফলাফলে পড়িতে না দেওয়া— প্রতিটি কাজেই বিজেপি সফল হইয়াছে। এমনই সফল যে দুর্জনে বলিবে, অমিত শাহের কাজ কমিয়া গেল— ভোটের পর বিধায়ক কেনা-বেচার ঝামেলাটিও আর থাকিল না। এই সাফল্যের কৃতিত্ব প্রাপ্য বিজেপির রণকৌশলের। প্রতিটি ধাপেই সেই কৌশল অব্যর্থ প্রমাণিত হইয়াছে। এনডিএ-র সঙ্গ ত্যাগ করিয়া চিরাগ পাসোয়ান নীতীশ কুমারের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাইলেন, কিন্তু বিজেপির প্রতি নিজের আনুগত্যের কথা জানাইতেও ভুলিলেন না। তাঁহার লোক জনশক্তি পার্টি একটিও আসন পায় নাই, কিন্তু সাড়ে পাঁচ শতাংশ ভোট পাইয়াছে। সেই ভোট কোথা হইতে আসিল, তাহা নিশ্চিত ভাবে বলিবার উপায় নাই— কিন্তু স্মরণে রাখা প্রয়োজন, জেডিইউ এবং এলজেপি, উভয় দলই মহাদলিত রাজনীতির উপর নির্ভরশীল। অন্য দিকে, একাদিক্রমে পনেরো বৎসর ক্ষমতায় থাকিবার ফলে এনডিএ-র বিরুদ্ধে যে স্বাভাবিক অসন্তোষ বিহারে জমিয়াছিল, ঘটনাক্রমে তাহার সম্পূর্ণটাই নীতীশ কুমার নিজের ঘাড়ে টানিয়া লইলেন— নরেন্দ্র মোদীর উন্নয়নের কথা বলিয়া ভোট চাহিলেন। ক্ষমতামন্থনে উঠিয়া আসা বিষ পান করিতে শরিককে বাধ্য করিতে পারা, জোট রাজনীতিতে তাহা কম কথা নহে।
তেজস্বী যাদবের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত জোড়া রণকৌশলও সমান ফলপ্রসূ হইয়াছে। লালু প্রসাদ যাদবের পুত্র দলের সনাতন ভোটব্যাঙ্ককে অতিক্রম করিয়া বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর উদ্দেশে উন্নয়নের বার্তা দিতেছিলেন। জবাবে নরেন্দ্র মোদী বারে বারে ‘জঙ্গলরাজ’-এর কথা ফিরাইয়া আনিয়াছেন। তাহাতে শুধু লালু প্রসাদ-রাবড়ী দেবীর শাসনকালে বিহারের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কথা জনস্মৃতিতে ফিরিয়া আসে নাই, উচ্চবর্ণের ভোটারদের তথাকথিত নিম্নবর্গের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের কথা মনে পড়িয়া গিয়াছে। ফলে, পর্যবেক্ষকরা বলিতেছেন, উচ্চবর্ণের ভোট জমা হইয়াছে বিজেপির ঝুলিতে। অন্য দিকে, সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত সীমাঞ্চলে আসাদুদ্দিন ওয়েইসির দল এমআইএম শুধু পাঁচটি আসনে জয়ীই হয় নাই, অন্য আসনেও আরজেডি-র ভোটে ভাগ বসাইয়াছে। মহারাষ্ট্রই হউক বা বিহার, এমআইএম যে ভাবে মুসলমান ভোটব্যাঙ্কে ভাগ বসাইয়াছে, তাহাতে সর্বাপেক্ষা লাভবান বিজেপি। নেহাত সমাপতন, না কি ইহাও রণকৌশল? আগামী বৎসর পশ্চিমবঙ্গে ওয়েইসির সম্ভাব্য ভূমিকা লইয়া যে জল্পনা চলিতেছে, তাহা অকারণ নহে।
লকডাউনের ফলে পরিযায়ী শ্রমিকরা যে সঙ্কটে পড়িয়াছিলেন, তাহার সর্বাধিক প্রভাব বিহারের রাজনীতিতে পড়িবে, এমন একটি সম্ভাবনার কথা আলোচিত হইতেছিল। সেই প্রভাব বিজেপির পক্ষে নেতিবাচক হইবে, তেমনই আশঙ্কা ছিল। ফলে, প্রশ্ন উঠিতেছিল, প্রচারের দ্বিতীয় দফা হইতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যে ভঙ্গিতে রাজ্যে বিজেপির মুখ হইয়া উঠিলেন, তাহা বিপরীত ফলদায়ী হইবে না তো? বিজেপি প্রমাণ করিল, রণকৌশল স্থির করিতে তাহাদের ভুল হয় নাই। পরিযায়ী শ্রমিকদের ভোট যদি বিজেপির বিরুদ্ধেও যায়— বামপন্থী দলগুলির ভাল ফলাফল তেমন একটি ইঙ্গিত করিতেছে— তবুও, লালু প্রসাদ-পর্বের আতঙ্কের পুনর্নির্মাণ ও রামমন্দির-কেন্দ্রিক হিন্দুত্বের বলিষ্ঠ প্রচার উচ্চবর্ণের হিন্দু ভোটকে বিজেপির দিকে টানিয়া আনিয়াছে। বিজেপির রণকৌশল কতখানি কার্যকর হইতে পারে, বিহারের নির্বাচন শেষ অবধি তাহার অভিজ্ঞান হইয়া থাকিল।