প্রতীকী ছবি।
ভারতীয় সংবিধান জাত হইবার পর তাহার যে কয়েকটি পরিবর্তন বা সংশোধন সাধিত হইয়াছে, তন্মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুতরটির ব্যবস্থাপনা হইল গতকাল, এমন বলা যাইতেই পারে। স্বাধীনতা লাভ ও সংবিধান লাভের সময় হইতে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের সহিত জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যটির যে সম্পর্ক, তাহার আমূল পরিবর্তন ঘটিতে চলিয়াছে। এত দিন অবধি একমাত্র এই রাজ্যেই রাষ্ট্রীয় সংবিধানের পাশাপাশি একটি নিজস্ব সাংবিধানিক কার্যধারা ছিল, স্বাধীনতার বাহাত্তর বৎসর পূর্তির পূর্বপ্রহরে তাহা কার্যত অতীত ইতিহাসে পর্যবসিত। দেশের সংবিধানের ৩৭০ ধারা এই রাজ্যকে একটি আলাদা মর্যাদার অধিকারী করিয়াছিল, অন্যান্য অঙ্গরাজ্য হইতে জম্মু ও কাশ্মীরের যে পার্থক্যের ভিত্তি রচনা করিয়াছিল, ৩৫-এ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাজ্যের অধিবাসীদের ভূমিপুত্র হিসাবে যে সব অধিকার দিয়াছিল— সবই লুপ্ত হইল। কেন্দ্রীয় সরকার এক অস্ত্রে দুইটি বড় উদ্দেশ্য সাধন করিতে চাহিতেছে। কাশ্মীর অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং তাহাদের পাকিস্তানি মদতদাতাদের কঠোর বার্তা পাঠাইল যে, জম্মু ও কাশ্মীর সমগ্র অঞ্চলটির প্রশ্ন ভারতের সার্বভৌমতার প্রশ্নের সহিত সংযুক্ত, কোনও বিদেশি শক্তি যেন ইহাতে নাক গলাইতে না আসে। সঙ্গে সঙ্গে দেশের মধ্যেও বার্তা পাঠাইল যে, কাশ্মীরকে আলাদা করিয়া দেখিবার প্রয়োজন নাই, সে রাজ্যের ভূমিপুত্ররা অতঃপর কোনও ‘বিশেষ’ মর্যাদার অধিকারী নহেন। কয়েক দশক ধরিয়া যে রাজ্যে মর্যাদা ও স্বাধিকারের দাবিতে ভারতীয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রবল লড়াই চলিয়া আসিতেছে, সেখানে এমন পরিবর্তনের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যঞ্জনা কেমন হইতে পারে, আন্দাজ করা সম্ভব। প্রধান নেতাদের গৃহবন্দি করা সত্ত্বেও রাজ্যের নেতৃসমাজ ও নাগরিকসমাজ যে ইহার ফলে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষোভ ও আক্রমণ-প্রবণতায় দগ্ধ হইবেন, সেই আশঙ্কা প্রবল। কাশ্মীর সঙ্কটের এখানেই অবসান— এমন কথা ভাবিবার কিছুমাত্র কারণ নাই।
একাধিক প্রশ্ন উঠিতে পারে। প্রথমত, ৩৭০ ধারা যখন প্রথমাবধি সাময়িক এবং/অর্থাৎ পরিবর্তনীয় ছিল, সে ক্ষেত্রে তাহার পরিবর্তনকে কেন এত ঐতিহাসিক বলা হইবে। উত্তরটি লুকাইয়া স্বাধীনতার ইতিহাসের মধ্যে। ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের সময় কাশ্মীরের বিতর্কিত অবস্থান ও শেষ পর্যন্ত ভারতে তাহার অন্তর্ভুক্তির শর্ত হিসাবেই এই বিশেষ ধারা তৈরি হইয়াছিল। কাশ্মীরের জন্য একটি পৃথক মর্যাদার ‘অঙ্গীকার’ ছিল এই বিশেষ ধারাটি। অর্থাৎ কেহ বলিতে পারেন, অঙ্গীকার ফিরাইয়া লইবার মধ্যে ভারতীয় রাষ্ট্রের দিক দিয়া একটি বড় মাপের ‘চুক্তিলঙ্ঘন’ এবং তজ্জনিত আস্থাভঙ্গ রহিয়াছে। আস্থা একটি দ্বিপাক্ষিক বোঝাপড়ার বিষয়। জোর করিয়া চাপাইবার মধ্যে বোঝাপড়ার প্রসঙ্গ উঠিতে পারে না।
পরবর্তী প্রশ্ন, কাশ্মীরে আদৌ কোনও বোঝাপড়ার সম্ভাবনা ছিল কি না। যে অন্তহীন রক্তক্ষয়ের মধ্য দিয়া কাশ্মীর গিয়াছে, তাহাতে কি সত্যই আর দ্বিপাক্ষিক ভাবে স্বীকৃত সিদ্ধান্ত সম্ভব হইত? মুশকিল হইল, ফল হউক আর না হউক, গণতন্ত্র নীতিগত ভাবে এই বোঝাপড়ার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। লক্ষণীয়, এই কাজ করিবার সময় পাশে বেশ কিছু বিরোধী দলকে পাইয়া গেলেও অমিত শাহেরা নির্বাচনী মিত্র নীতীশ কুমারের বিরুদ্ধতার সম্মুখীন হইয়াছেন। রাজ্যসভায় অনেক সাংসদই মৌলিক প্রশ্নটি তুলিয়াছেন যে, ‘ভারতমাতা কি জয়’ স্লোগানের মধ্য দিয়া কোনও কার্য সমাধা হইলেই কি তাহা ‘সিদ্ধ’? এত গুরুতর একটি পরিবর্তনের জন্য, কাশ্মীরিদের সহিত না হউক, অন্তত সংসদে উপস্থিত সকল সাংসদের আলোচনার জন্য কিছু সময় কি ধার্য রাখা জরুরি নয়? দুর্ভাগ্য— এমন এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত, দ্বিপাক্ষিক স্বীকৃতি দূরস্থান, যথার্থ গণতান্ত্রিক রীতির অনুমোদনও পাইল না।