জ্যেষ্ঠ পুত্রের জন্ম-পত্রিকায় মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘‘শুক্লপক্ষ, ১৩০১ সাল, ২৮শে ভাদ্র, বুধবার দিবা সাড়ে দশ ঘণ্টার সময় আমার বিভূতিভূষণ পুত্রের জন্ম হয়। মুরাতিপুর গ্রামে। ইঙ্গরাজী ১৮৯৪।১২ সেপ্টেম্বর।’’
মুরাতিপুর কাঁচড়াপাড়া সংলগ্ন একটি গ্রাম। কল্যাণী থেকে যে গ্রামের দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটারের মতো। মুরাতিপুরের অবস্থান নদিয়ায়। শুধু জন্মস্থানই নয়, বিভূতিভূষণের জীবন ও সৃষ্টির পরতে পরতে মিশে রয়েছে নদিয়া। মুরাতিপুর গ্রামে ছিল বিভূতিভূষণের মামার বাড়ি। এখানে গুরুচরণ চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা মৃণালিনীর সঙ্গে বিবাহ হয় মহানন্দের। মুরাতিপুর ঘোষপাড়া কর্তাভজা সম্প্রদায়ের পীঠস্থান। বড় হয়ে এখানে একাধিক বার দোল দেখতে এসেছেন বিভূতিভূষণ।
বিভূতিভূষণের সঙ্গে নদিয়ার যোগ তাঁর পিতার সূত্র ধরলে আরও কিছুটা পিছিয়ে যেতে হবে। মহানন্দের প্রথম স্ত্রী হেমাঙ্গিনীর বাবা খগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ছিলেন রানাঘাটের নামকরা উকিল। যৌবনে মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় কথকতা করতে গোয়াড়ী কৃষ্ণনগর, মুড়াগাছার ধর্মদহে অনেক বার এসেছেন। সুতরাং, শুধু মুরাতিপুর নয়, বিভূতিভূষণের সঙ্গে নদিয়ার আত্মীয়তা ও আত্মিকতার বীজ রোপিত হয়েছিল আরও আগে।
বিভূতিভূষণ নিজে কৃষ্ণনগর এসেছিলেন বার তিনেক। ‘ঊর্মিমুখর’ দিনলিপিতে রয়েছে ১৯০৮/৯ সালে বিভূতিভূষণ বাবার সঙ্গে গোয়াড়ী কৃষ্ণনগর আসেন। এর পরে আসেন অনেক বছর পরে। ‘ঊর্মিমুখর’-এ রয়েছে, ‘‘আজ সকালে গোয়াড়ী কৃষ্ণনগর গেলুম সকালের গাড়িতে। অনেক জায়গায় গেলুম, কারণ বাবার সঙ্গে সেই ছেলেবেলায় একবার গিয়েছিলুম, আজ সাতাশ বছর আগে।’’ খুব বেশি সময়ের জন্য তিনি সে বার আসেননি। তবু রাজবাড়ির ফটকের সামনে গিয়েছেন, অন্য গন্তব্য হিসাবে এভি স্কুল, ব্রাহ্মসমাজ, লীলাদের বাড়ির উল্লেখ রয়েছে। সম্ভবত লীলাদের বাড়ি ছাড়া অন্য সবগুলির পাশ দিয়ে গিয়েছেন, ভিতরে ঢোকেননি। কৃষ্ণনগরে এই দ্বিতীয় বার আসার উদ্দেশ্য এই দিনলিপিতে পরিষ্কার নয়।
তবে ‘উৎকর্ণ’ দিনলিপিতে রয়েছে ছোট ভাইয়ের জন্য এক বার পাত্রী দেখতে তিনি কৃষ্ণনগর এসেছিলেন। ভাই নুটুবিহারীর বিয়ে হয় ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বর মাসে। পাত্রী অবশ্য এখানকার নয়, ভাটপাড়ার। তবে নুটুবিহারীর বিয়ের দেখাশোনা চলছিল অনেক দিন ধরেই। হয়তো সেই দেখাশোনা পর্বে কোনও পাত্রীর সন্ধান পেয়ে সে বার তিনি কৃষ্ণনগর এসেছিলেন। ‘ঊর্মিমুখর’ শেষ হচ্ছে ১৯৩৬ সাল নাগাদ। সুতরাং ‘ঊর্মিমুখর’-এ তাঁর কৃষ্ণনগর আসার যে কথা রয়েছে, তা সম্ভবত ভাইয়ের পাত্রী দেখতেই।
এর বছরদুই পরে বিভূতিভূষণ কৃষ্ণনগর এসেছিলেন সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিতে। সে দিন কৃষ্ণনগর এসেছিলেন সকাল ৯টার গাড়িতে। এই সম্মেলনে সজনীকান্ত, প্রবোধ সান্যাল, অমল বোস, অতুল গুপ্ত, যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়, বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়-সহ সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের বিখ্যাত মানুষ যোগ দিয়েছিলেন। সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতি হয়েছিলেন প্রমথ চৌধুরী। সভা বসেছিল কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির নাটমন্দিরে। আর খাওয়া-দাওয়া? ‘‘মনোমোহন ঘোষের যে বাড়িতে আজকাল কলেজিয়েট স্কুল, ওখানেই খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল’’— জানাচ্ছেন বিভূতিভূষণ।
সম্মেলনের দিনটা নির্দিষ্ট করে বিভূতিভূষণ জানাননি। তবে দিনটা সম্ভবত সরস্বতী পুজোর পরের দিন। কেননা বিভূতিভূষণ লিখছেন, ‘‘কৃষ্ণনগর থেকে সেই রাত্রে রাণাঘাটে এসে খগেনমামার বাড়িতে রইলুম...একটা সরস্বতী ঠাকুর বিসর্জ্জন দিতে গেল শোভাযাত্রা করে অনেক রাত্রে।’’
কৃষ্ণনগর ছাড়া বিভূতিভূষণ নদিয়ার মুড়াগাছাতে এক বার এসেছিলেন একটা লাইব্রেরির বার্ষিক উৎসবে। ‘উৎকর্ণ’-এ রয়েছে সেই মুড়াগাছা ভ্রমণের কথা। তারিখটা বিভূতিভূষণ লিখেছেন ২৮ অক্টোবর। ‘উৎকর্ণ’ শুরু হয়েছে ১৯৩৬ সালের ১১ অক্টোবর। সে হিসাবে মুড়াগাছা ভ্রমণের সালটা ১৯৩৬ হওয়ারই সম্ভাবনা। মুড়াগাছায় ছিলেন জমিদার লোহারাম মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে। খুব যত্নআত্তিও পেয়েছিলেন সেখানে। মুখুজ্যে বাড়ির বিলাতফেরত ছেলে অনেক রাত পর্যন্ত স্পেনের গল্প করেছিল। সকালে গ্রাম বেড়িয়ে খুব খুশি হয়েছিলেন বিভূতিভূষণ। স্কুলের মাঠে বেড়াতে গিয়ে কাছের ধর্মদহ গ্রামে বাবার কথকতা করতে আসার কথাও মনে পড়েছিল। অনুষ্ঠান হয়েছিল সে দিন বিকেলে। খুব বেশি ক্ষণ বিভূতিভূষণ অনুষ্ঠানে ছিলেন না। বাড়ি ফিরেছিলেন সে দিন রাতের গাড়িতে। বিভূতিভূষণের শিক্ষকতার জায়গা ছিল গোপালনগর। গোপালনগর উত্তর ২৪ পরগনায় হলেও বনগাঁ-ব্যারাকপুর থেকে যেমন কাছে, তেমনি রানাঘাট থেকেও খুব কম সময়ের পথ। অনেক সময় বিভূতিভূষণ রানাঘাট নেমে গোপালনগর যেতেন। আবার গোপালনগর থেকে কলকাতা যাওয়ার দরকার পড়লেও রানাঘাট হয়েই যেতেন। রানাঘাটে রাত্রিবাসও করেছেন বহু বার।
হয়তো এ কারণেই রানাঘাট বিভূতি-সাহিত্যে ফিরে ফিরে এসেছে। ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ তো রানাঘাটেরই উপাখ্যান। রানাঘাটের রেলবাজারে বেচু চক্কত্তির হোটেলের পদ্ম ঝি আর হাজারি ঠাকুরকে বাংলা সাহিত্যের পাঠকেরা কে না চেনেন! ‘বিপিনের সংসারে’র ঘটনাস্থল রানাঘাটেরই আশেপাশের গ্রাম। বিপিনের ভাই বলাই ভর্তি ছিল রানাঘাটের মিশনারি হাসপাতালে। এই উপন্যাসের শেষে বিপিনের সঙ্গে মানীর দেখা হয়েছিল রানাঘাট স্টেশনেই। এই সাক্ষাতের তাৎপর্য রয়েছে। কেননা এই সাক্ষাৎ না ঘটলে মানীর পরামর্শে বিপিনের সংসারের কক্ষপথে ফেরা হত না। তাই এই উপন্যাসেও রানাঘাট রয়েছে একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান হয়ে। শুধু রানাঘাট নয়, বিভূতি-সাহিত্যে নদিয়ার আরও অনেক জায়গা রয়েছে বিভিন্ন ঘটনার পটভূমিকায়। ‘পথের পাঁচালী’তে দুর্গার মৃত্যুর সমকালে হরিহর ছিলেন গোয়াড়ী কৃষ্ণনগরে। এই সময় এখানে হরিহর কিছুটা হলেও আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য পেয়েছিলেন, যার উপর ভর করে হরিহর বাড়ি ফিরতে পেরেছিলেন। আর ‘অপরাজিত’ উপন্যাসে যে মনসাপোতা থেকে সর্বজয়া ও অপু নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিল, সেটি নদিয়ার আড়ংঘাটার পাশেই।
অপরাজেয় কথাশিল্পী বিভূতিভূষণের জীবন ও সৃষ্টির সঙ্গে এ ভাবেই নদিয়া মিশে রয়েছে নানা ভাবে। ১২ সেপ্টেম্বর বিভূতিভূষণের জন্মদিনে নদিয়া তাই একটু বাড়তি আনন্দ অনুভব করতেই পারে।
(উদ্ধৃতির মধ্যে বানান অপরিবর্তিত)
শিক্ষক, ভগবানগোলা হাইস্কুল
তথ্যঋণ: ১। ‘ঊর্মিমুখর’/ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
২। ‘উৎকর্ণ’/ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
৩।‘বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়’/ রুশতী সেন