ছবি: সংগৃহীত
কোনও ঘটনা মনে না পড়লে নীলমণি (চক্রবর্তী)-কে খুঁজে বের করত স্কুলের বন্ধুরা। সাল-তারিখ গড়গড় করে বলে দিতে পারে। পুরনো কাগজ জমানো তার নেশায় পরিণত হয়েছিল। তখন অবশ্য ওগুলোকে কাগজই বলা হত। এখন সব নথি। কখনও আবার নথিও কাগজ হয়ে যায়। নীলমণির কাছে অবশ্য কোনও কাগজের গুরুত্বই কম নয়।
পাঠশালার পরীক্ষার প্রশ্নগুলিও বহু দিন রাখা ছিল। সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা। কারও কোনও কাগজ চাই, নীলমণিকে বলো! বিদ্যুতের বিল থেকে খাজনার রসিদ। মা’ও বলতেন, ‘তোর বড্ড বাড়াবাড়ি।’
নীলমণি এখন অবসরের দোরগোড়ায়। বার বার বাড়ি বদলের ফলে প্রশ্নের তাড়া ফেলে দিতে হয়েছে। আরও কত কাগজ ছেড়ে আসতে হয়েছে। শুধু হাতছাড়া করেননি মার্কশিট। ১৯৬৮ সালে করিমগঞ্জ জেলার বিপিন পাল বিদ্যানিকেতনে সপ্তম থেকে অষ্টম শ্রেণিতে ওঠার সময় চতুর্থ হয় নীলমণি। প্রৌঢ়ত্বের শেষ সীমায় পৌঁছে ওই মার্কশিটটা খুলে সে দিনের উত্তেজনা টের পান। মায়ের স্বাক্ষর রয়েছে প্রতিটি মার্কশিটে। স্পষ্ট হস্তাক্ষরে লেখা: ‘শ্রী চারুপ্রভা চক্রবর্ত্তী’। তখন ওই বানানই লেখা হত, মহিলারাও ‘শ্রী’ লিখতেন। শৈশবেই বাবাকে হারিয়েছেন নীলমণি। চারুপ্রভা দেবী ছিলেন তাঁর কাছে মা-বাবা। নীলমণির কাছে তাই মায়ের নার্সের চাকরির প্রথম চিঠিটিও অতি মূল্যবান। ১৯৬০ সালের ১২ মে করিমগঞ্জ মহকুমা শাসকের অফিস থেকে চারুপ্রভা দেবীকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। তখন পিতৃহারা নীলমণির বয়স চার। আজ চারুপ্রভা দেবী বেঁচে নেই। খামগুলোও সযত্নে রেখেছেন নীলমণি। মায়ের ছোঁয়া অনুভব করেন।
পুরনো নথি খুলে তার প্রাচীনতাও দেখেন নীলমণি। ১৯৬০, ’৬৮, ’৬৯, ’৭০ সালের। ১৯৭১ সালের আগের কত নথি! এনআরসি-তে ’৭১-কেই ভিত্তিবর্ষ ধরা হয়েছে। ‘এটা ১৯৬৬ হলেও ভয়ের নেই’— ছেলেমেয়েদের কত বার শুনিয়েছেন সে কথা। কিন্তু তিনিই আজ রাষ্ট্রহীন হওয়ার পথে। অ-নাগরিক! এনআরসি-তে তাঁর নাম নেই। বাদ পড়েছেন তাঁর ছেলেমেয়েও দু’টিও। সিএএ-র পর অনেকে প্রবোধ দেন, হিন্দুর আবার এনআরসি নিয়ে চিন্তা কিসের? মেজাজ হারান নীলমণি। নথির স্তূপ দাঁড় করিয়ে জানতে চান, ‘এর পরও নাগরিকত্ব ভিক্ষা চাইব? বলব, ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশ থেকে এসেছেন আমার বাবা-ঠাকুরদা? না হয় বললামই আমি, কিন্তু আমার ছেলেমেয়ে দুটোর চাকরির কী হবে? বাংলাদেশি হিসেবে চাকরি করছিল এত দিন?’
‘কেন নিজেকে বাংলাদেশি বলব?’— ঠাকুরদার রিফিউজি কার্ড, জমির দলিল হাতে উত্তর খোঁজেন কাছাড় জেলার রংপুরের অজিত রায়। তিন ভাই, তিন বোন। ঠাকুরদা যখন পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে আসেন, তখন কারও জন্ম হয়নি। জন্ম হয়নি বাংলাদেশেরও। ভারত সরকার উদ্বাস্তু হিসেবে ঠাকুরদাকে গ্রহণ করে। ১৯৭০ সালে দিয়েছিল এক টুকরো জমি পান। এনআরসি-র আবেদন করতে গিয়ে তাই রিফিউজি কার্ডের সঙ্গে জমির দলিলও জুড়ে দিয়েছিলেন অজিতবাবু। জেঠু, কাকু এবং তাঁদের ছেলেমেয়েরাও একই নথিতে আবেদন করেন। কিন্তু হায়! অজিতবাবুর বড়দা ও তিন বোনকে সরকার ভারতীয় বলে মেনে নিলেও রাষ্ট্রহীনের তালিকায় অজিতবাবু ও তাঁর অনুজ, সঙ্গে তাঁদের সন্তানেরাও।মধুরার কাহিনি আরও চমকপ্রদ। ছোট থেকে সে শুনেছে, ‘তুই তো ইতিহাসের নাতি!’ ‘ঐতিহাসিক’ শব্দটা বন্ধুদের কঠিন মনে হত বলে ‘ইতিহাসের নাতি’। বরাক উপত্যকায় অনেক লেখাতেই ইতিহাসবিদ দেবব্রত দত্তকে উদ্ধৃত করা হয়। তিনি যা লিখে গিয়েছেন, তা-ই প্রামাণ্য নথি। তাঁর তৈরি ‘কাছাড় ডিস্ট্রিক্ট রেকর্ডস’ এশিয়াটিক সোসাইটি পূর্ণাঙ্গ রূপে প্রকাশ করে। তাঁরই নাতনি অ-নাগরিকের খাতায়, তখন শহরের অনেকে বাক্যহীন। হাসে শুধু মধুরা। এনআরসি-তে দাদুকে সে জোড়েনি, কিন্তু মা-বাবা দুজনকেই রাষ্ট্র ভারতীয় বলে মেনে নিয়েছে! মধুরার বাবা মনোজ দেব আকাশবাণী শিলচর কেন্দ্রের অবসরপ্রাপ্ত ঘোষক। মা দেবশ্রী দত্ত শিলচর মহিলা মহাবিদ্যালয়ে ইতিহাস পড়ান। তাঁদের বক্তব্য, নাগরিকত্ব আইনেই তো বলা হয়েছে যে মা-বাবা ভারতীয় হলে সন্তানরাও ভারতীয়। তবে কি নাগরিকপঞ্জি তৈরি করতে গিয়ে নাগরিকত্ব আইনকেও অস্বীকার করা হচ্ছে? উত্তর নেই। কার কাছে প্রশ্নগুলো করা, তা-ও স্পষ্ট নয়।