দোলোৎসবের পূর্বে বাংলার শহর-গ্রামে বহ্ন্যুৎসবের প্রচলন কমিয়াছে। খেজুর-নারিকেলের শুষ্ক পাতা, শীতে ঝরিয়া-পড়া কাঠকুটা, সংবৎসরের আবর্জনা জড়ো করিয়া আগুন লাগাইত সকলে। হর্ষধ্বনি উঠিত ‘আজ আমাদের ন্যাড়াপোড়া, কাল আমাদের দোল।’ ইদানীং দোল খেলা লইয়া মাতামাতি বাড়িয়াছে। দোলপূর্ণিমার তিন-চার দিন পূর্বেই রং মাখাইবার পালা শুরু হয়। কিন্তু আনন্দের সহিত আবর্জনা-বিদায়ের উৎসবটি প্রায় বিস্মৃত হইয়াছে। আজ এই পর্বটিরই পুনরুদ্ধার প্রয়োজন। আবর্জনা সাফ করিবার কর্তব্যটি খুব লোভনীয় নহে, কিন্তু সকলে মিলিয়া করিবার উদ্দীপনায় তাহাও আনন্দময় হইয়া ওঠে। জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা এবং পরিবেশের স্বচ্ছতা, এই দুইটি নিশ্চিত করা উত্তম প্রতিবেশিতার একটি অঙ্গ। বাহিরের প্রকৃতি হইতে গৃহস্থের অন্দর বিচ্ছিন্ন নহে। নগর-গ্রামের রাস্তাঘাট, মাঠ-জলাশয় লইয়া যে বাস্তুতন্ত্র, তাহা বাস্তুভিটারই প্রসারিত অংশ। এই সহজ কথাটি এখন ‘পরিবেশ বিজ্ঞান’ নাম লইয়া পাঠ্যবিষয়মাত্র। যত্রতত্র আবর্জনা, প্লাস্টিক, থার্মোকলের বাসন ফেলিবার ঝোঁক তাহারই পরিচয়। পোস্টার আঁকিয়া, রচনা লিখিয়া প্রতিবেশিতার ধর্ম পালন সম্ভব নহে। তাহার জন্য কোমর বাঁধিয়া হাত নোংরা করিতে হইবে।
এক সময়ে সে-কাজটি পাড়ার তরুণ-তরুণীরা উৎসাহের সঙ্গেই করিতেন। আক্ষেপের বিষয়, স্বেচ্ছা-উদ্যোগে সংগঠিত কাজের অনুপ্রেরণার উৎস পাড়ার অভ্যন্তর হইতে ক্রমশ সরিয়া গিয়াছে সরকারি দফতর ও রাজনৈতিক দলে। সরকারি প্রকল্পের প্রচারে নেতারা ঝাঁটা লইয়া রাস্তায় দর্শন দেন। দেখাদেখি পারিষদ দল ধুলা উড়াইতে রাস্তায় নামিয়া পড়ে। তাহাতে কোথাকার ধুলা উড়িয়া কোথায় পড়িল, রাস্তার সহিত জলাশয়েরও জঞ্জাল সাফ হইল কি না, কে দেখিতে যায়? সরকারি নির্দেশ কিংবা দলের অনুশাসন মানিয়া অনুগতদের ঝাঁটা চালাইতে হয়। আর বিপরীত মতের মানুষেরা সরিয়া থাকেন। এক দলের চিকিৎসাশিবির শূন্য পড়িয়া থাকিলেও অপর দল ডাক্তার দেখাইতে যাবে না। এক দল রাস্তা সাফ করিলে অন্যে সে-পথ মাড়াইবে না। পাড়ার কাজের পথ তো এমন নহে। প্রতিবেশীর কল্যাণ তাহার একমাত্র উদ্দেশ্য। দশে মিলিয়া কাজ করিবার আনন্দই তাহার পুরস্কার।
তেমন মিলনের উপলক্ষই তো উৎসব। প্রতি প্রজন্ম নূতন উৎসবের প্রচলন করে, পুরাতন উৎসবকে নূতন রূপ দেয়। রবীন্দ্রনাথ-প্রবর্তিত বসন্তোৎসবের আঙ্গিকে আজ কলিকাতার পাড়ায় পাড়ায় দোল উদ্যাপিত হয়। বর্ষবরণ, বৃক্ষরোপণ প্রভৃতির উৎসও শান্তিনিকেতন। দোলের পূর্বে আবর্জনা দূর করিবার উৎসবটি আজ বাংলার পাড়ায় পাড়ায় নবরূপে গৃহীত হইবার অপেক্ষায়। তাহার সংস্কার অবশ্যই প্রয়োজন। আগুন লাগাইলে দূষণ ছড়াইবে, অতএব পুড়াইবার চেষ্টা বর্জনীয়। কিন্তু এলাকার জঞ্জালমুক্তিতে পাড়ার সকলের অংশগ্রহণ একান্ত প্রয়োজন। বৎসরে এক দিনও সকলে যে-সকল পথঘাট পরিষ্কার করিতে হাত লাগাইবে, বাকি তিনশো চৌষট্টি দিন তাহা নোংরা করিতে দ্বিধা করিবে না কি? পিকনিক, পূজার বিশৃঙ্খল উল্লাসের বাহিরে, জাত-ধর্ম-লিঙ্গ বৈষম্যের ঊর্ধ্বে, পরিচ্ছন্ন প্রতিবেশ উদ্যাপনের উৎসব বাঙালির একান্ত প্রয়োজন।