Editorial news

বানান ভুলে নম্বর কাটার বিতর্ক? বাঙালি নিজের ভাষায় দুরস্ত নয়

মধ্যশিক্ষা পর্ষদের তরফে কিছু দিন আগে জানানো হয়েছিল, বোর্ডের পরীক্ষায় কয়েকটি বিষয়ে বানান ভুল হলে নম্বর কাটা যাবে না। এহেন ফতোয়ায় হই হই কাণ্ড।

Advertisement

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ মার্চ ২০২০ ১০:০০
Share:

মধ্যশিক্ষা পর্ষদের তরফে কিছু দিন আগে জানানো হয়েছিল, বোর্ডের পরীক্ষায় কয়েকটি বিষয়ে বানান ভুল হলে নম্বর কাটা যাবে না।

বাংলার ‘বা’, চানাচুরের ‘না’ আর লিমকা-র ‘ম’— এই তিনে মিলে ‘বানাম’। না, ‘বানান’ নয়, ‘বানাম’। এই না লিখলে বানান পোক্ত হয় না। নিজের স্থানিক-কালিক পরিসর স্পষ্ট হয় না, আজকের নিক্তিতে দেখলে ‘ক্রোনোলজি’-ও ফুটে ওঠে না। ‘বানান’ দুরস্ত না হোক, যে করে পার ‘বানাম’ দুরস্ত হতেই হবে। নইলে…

Advertisement

মধ্যশিক্ষা পর্ষদের তরফে কিছু দিন আগে জানানো হয়েছিল, বোর্ডের পরীক্ষায় কয়েকটি বিষয়ে বানান ভুল হলে নম্বর কাটা যাবে না। এহেন ফতোয়ায় হই হই কাণ্ড। ফেসবুক জুড়ে উথালপাথাল। ২১ ফেব্রুয়ারি সদ্য গত হয়েছে। ভাষা নিয়ে পোস্টগুলো এখনও তামাদি হয়নি। আর তারই মধ্যে কি না এমন নিদান! গেল গেল গেল সবে, শত বীণা বেনু রবে—বলে সকলেই প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ‘সকলে’ মানে ‘সুশীল সমাজ’-এর সেই অংশ, যাঁরা এই ‘বানাম’ নামক ঝঞ্ঝাটটির গূঢ়ার্থ জানেন, বোঝেন, অনুভব করেন। জানা নেই, বাংলা ভাষা ছাড়া এই বানান সংকট অন্য ভারতীয় ভাষাগুলো পোহায় কি না। জানা নেই, তাদের সকলের সাধু-চলিত ভেদ, সংসদ-চলন্তিকা-অ্যাকাডেমি ঘটিত গোল রয়েছে কি না। জানতে গেলে একটা প্রশ্ন হেলে সাপের কেতায় পা জড়িয়ে ধরে— নিজের মাতৃভাষাটাকে এখনও কব্জা করে উঠতে পারলে না, তো আবার প্রতিবেশীর কিচেনে উঁকি!

বাংলা বানানে নম্বর কাটা হবে না শুনে যাঁরা মাথা কাটা কনিষ্কের মেসোমশাই হয়ে ঘুরছিলেন, তাঁদের কাছে স্বস্তির বার্তা এই যে, সম্প্রতি পর্ষদ এ-ও জানিয়েছে, বানান ভেদে নম্বর কাটা হবে না। বানান ভেদ আর বানান ভুল— এদের মাঝখানের দূরত্ব কতটা? তা কি সমাধি ফলকে উৎকীর্ণ দুই তারিখের মতো দূরত্ব বিশিষ্ট? তা হলে কিছু বলার নেই। কিন্তু একটু ভাবলেই বোঝা যায়, এই দুই ধারণা— বানান ভুল আর বানান ভেদ মোটেই কোনও কাছাকাছি বিষয় নয়। এমনকি, তারা পরস্পর সন্নিবদ্ধও সে অর্থে নয়। আপনি ‘সাজাহান’ বা ‘শাহজাহান’— যা-ই লিখুন না কেন, কাকে মিন করতে চাইছেন তা ইতিহাসের পরীক্ষক ঠিক বুঝে যাবেন। ‘শাহজাহানের শাসনকালকে কি সুবর্ণ যুগ বলা যায়’— এই প্রশ্নের উত্তরে যদি কেউ সংশ্লিষ্ট মুঘল সম্রাটকে ‘সাজাহান’ বলে উল্লেখ করেন, তা হলে গোল বাধার কোনও কারণ নেই। কিন্তু ভূগোলের খাতায় ‘হিমালয়’-কে কেউ যদি ‘হীমালয়’ লেখে তা হলে ঘটনা আলাদা। ‘আমাজন’-কে ‘অ্যামাজন’ লিখলে চলতে পারে, কিন্তু ‘গঙ্গা’-কে ‘গংগা’ লিখলেও কি একই রকম ছাড় পাওয়া যাবে? এই সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া কঠিন।

Advertisement

আরও পড়ুন: করোনা: স্কুল-কলেজ বন্ধ, বোর্ড পরীক্ষা চালু

বাংলা বাজার খুবই ঝামেলার। আম বাঙালি যে নিজের ভাষাটাতেই দুরস্ত নয়, তার প্রমাণ প্রতি মুহূর্তে পাওয়া যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্ট থেকে। ণত্ব-ষত্ব বাদ দিন, জটিল ব্যাপার। য-ফলা র-ফলারও বাপান্ত। কী এসে যায় বানানে! মনের ভাব ফুটে উঠলেই তো হল। মনের ভাব ফোটাতে বানানের দাসত্ব করতে হবে কে বলেছে? এই তো হাতের কাছে দেদার ইমোজি। দাও না ঠুকে একখান। ফেসবুকওয়ালারা ‘লাইক’-এর জায়গায় ছ’খানা অপশন অলরেডি দিয়ে রেখেছেন। এর সংখ্যা অদূর ভবিষ্যতে বাড়বে বলেই মনে হয়। এতে না কুলোলে কি-বোর্ডে যান, ইমোজির সমুদ্রে হাবুডুবু খাবেন। কী দরকার আর শব্দের গোলামি করার, শব্দ আর সত্য যে সর্বদা সংশ্লিষ্ট নয়, তা ইমোজি-ভাষার ব্যবহারই প্রমাণ করে। অবশ্য চিহ্নতাত্ত্বিকরা এতে আপত্তি তুলবেন। তাঁরা বলবেন, ইমোজির পিছনে ঘন যামিনীর অন্ধকারে থমকে রয়েছে শব্দের দল, তাই তুমি অর্থ করতে পারছ। কিন্তু, অর্থহীনতাও তো সেখানে রয়েছে! তিনি বলবেন অর্থহীনতারও অর্থ হয় হে। তখন তুমি পড়বে ফাঁপরে। ছবি সেঁটে লিখনের হাত থেকে পার পাওয়ার চেষ্টার গুড়ে বালি, বাড়া ভাতে ছাই, পাকা ধানে মই তত ক্ষণে।

আরও পড়ুন: করোনা ঝুঁকির মধ্যে ভোট কী ভাবে, প্রশ্ন বিজেপির, নজর তৃণমূলের অবস্থানে

আর যাঁরা রোমান হরফে বাংলা লিখছেন, লিখে চলেছেন, তাঁদের কী হবে? বাংলা বানানবিধি কী ভাবে তাঁদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে? ‘আমাকে কী লিখতে হবে’ লিখতে গিয়ে প্রায়শই দেখা যাচ্ছে ‘amaka ki likhta hoba’। ইংরেজি ‘a’-কে যদি কেউ বাংলা ‘এ-কার’-এ ট্রান্সফার করেন, কী বলার আছে সে ক্ষেত্রে? আপনি বলে উঠতেই পারেন, সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্ট তো আর পরীক্ষার খাতা নয়, যে নম্বর কাটার প্রশ্ন উঠবে। কিন্তু এটাও তো মানতে হবে যে, সোশ্যাল মিডিয়ায় এই সব লিখন-কর্তারাও তো পরীক্ষায় বসেছেন, সেখানে কী কেরদানি দেখিয়ে এসেছেন তাঁরা?

মনের ভাব ফোটাতে গেলে যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকু হলেই তো যথেষ্ট। তা হলে কেন আবার বানান-টানানের প্যাঁচাল পাড়া? ইংরেজিতে তো এমনটা হওনের জো নেই! বানান ভুল তো ভুল। কাটো নম্বর ঘ্যাঁচ করে। বাংলায় কেন বাওয়াল বাওয়া! আর বানান ভেদ? এই নিয়ে তারাপদ রায়ের একটা রসিকতার কথা মনে পড়ছে। পূর্ববঙ্গের পশ্চিম দিকের কোনও এক জনপদের এক গেরস্ত বাড়িতে শিশুদের পড়াচ্ছেন নোয়াখালি বা চাটগাঁর এক মাস্টারমশাই। “সি এ টি ক্যাট ক্যাট মানে মেকুর”— এই বাক্যটি বার তিনেক আওড়ানোর পরে ক্ষেপে গেলেন কাছেই উপবিষ্ট অভিভাবক। তিনি রাগত স্বরে বললেন, “কেন পোলাপানরে ভুল শিখান মাস্টারমশাই। এই তো দেখতাসি সি এ টি ক্যাট মানে ব-য়ে হ্রস্ব ই, ড-য়ে শূন্য ড়-য়ে আকার আর ল। বিলাই। হ্যারে মেকুর মেকুর কইতাসেন ক্যান?” এই তর্কের কোনও মীমাংসা হয় কি? লক্ষণীয় এই যে মাস্টারমশাই আর অভিভাবক, দু’জনেই বাংলা বানানটা জানেন, চোখের সামনে দেখছেনও। ‘বিড়াল’ কী করে ‘বিলাই’ বা ‘মেকুর’-এ রূপান্তরিত হয়, তা বাংলা ভাষাই জানে, পুরুলিয়া থেকে নোয়াখালি পর্যন্ত ছড়ানো ‘বৃহৎ বঙ্গ’ জানে।

এই বিলাই-মেকুর বিতর্ক আজ আবার রেলেভ্যান্ট। কারণ, সোশ্যাল মিডিয়া এসে রজনৈতিক বিভাজনরেখা হঠিয়ে দিয়েছে। বর্ধমানের সঙ্গে বরিশালের মুহুর্মুহু ভাব-আড়ি বিনিময় ঘটে চলাটা কোনও ব্যাপারই নয়। সংস্থানগত পার্থক্যে উচ্চারণগত পার্থক্য ঘটবে, এটা স্বাভাবিক। সেই সঙ্গে বদলে যেতে পারে বানানও। এই সব যুক্তির পরেও আপনি বলতে পারেন, যে যার ব্যক্তিগত পরিসরে যা খুশি লিখুক না, তাই বলে পরীক্ষার খাতায়!

আচ্ছা, ‘পরীক্ষার খাতা’ কি নিছক পরীক্ষার খাতাই? তা কি সারা জীবনব্যাপী এক্সটেন্ডেড নয়? আপনার ছাত্রাবস্থার বানানজ্ঞান কি আপনার ধেড়ে বয়সে আপনার ভাষাজ্ঞানের পরিচয় বহন করে না? বানানটা কি ভাষার অ্যাকসেসরি ইউনিট? তা হলে কেন রবীন্দ্রনাথ থেকে রাজশেখর বসু, বুদ্ধদেব বসু থেকে জ্যোতিভূষণ চাকী এ নিয়ে প্রাণপাত পরিশ্রম করে গেলেন? এই শ্রমের, এই মননচর্চা কি তা হলে একেবারে মূল্যহীন? এই সব প্রশ্ন তুলতে গেলে আবার সেই শুরুর জায়গাতেই গোঁত্তা খেতে হয়। রবীন্দ্রনাথ না রাজশেখর, বুদ্ধদেব না জ্যোতিভূষণ— কে ঠিক? কার বানানটা অনুসরণযোগ্য? রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে জ্যোতিভূষণকে মিশিয়ে যদি কেউ বাংলা লেখেন তবে কেমন হবে? ‘বিষ্ণু’ আর ষ-এর তলায় বহ্নিশিখার মতো জ্বাজ্বল্যমান মূর্ধণ্য ণ কি এক? কে নির্ণয় করবে? এখানে মুখের ভাষা বিড়ম্বিত হল না বটে কিন্তু বাল্যকাল থেকে ‘ষ্ণ’ দেখে আসা চোখ আর মন তো হোঁচট খেলই। চেনা শব্দের সংস্থান গেল ঘেঁটে। সেটা কি কোনও ব্যাপার নয়? বানান ভেদ ব্যাপারটাও প্রায় সমপরিমাণ গোলমেলে। ‘ধূ ধূ প্রান্তর’ লিখলে যা ফুটে ওঠে ‘ধু ধু প্রান্তর’-এ কি তা কুলোয়?

ভাষাকে সহজ করতে গিয়ে বহু দীর্ঘ ঈ আর ঊ হ্রস্ব ই আর ঊ হয়ে গিয়েছে, আমরা তা মেনেও নিয়েছি। কিন্তু তার পরে যদি কেউ বর্জিত বানানের পাশাপাশি চলিত বানান লিখে যেতে থাকেন। ‘গাড়ি চড়ে বাড়ী ফেরা’-র মতো বাক্য রচিত হয়, তা কি গুরুচণ্ডাল-তূল্য হয়ে যাবে না? যে ভাষায় আজও ‘তিনি তোমার কে হয়’ আকছার লেখা হয়ে চলেছে, জীবিত ব্যক্তির ক্ষেত্রে ‘তেনার’ বা ‘ওনার’ লেখা হয়ে চলেছে ‘তাঁর’ বা ‘ওঁর’-র বদলে, সেখানে পরীক্ষার খাতা কি পর্ষদের ছাপ দেওয়া সাদা পাতাতেই শেষ? কী হবে সেই প্রজন্মের যাঁরা ‘ষ্ণ’ দেখলেন না পাঠ্যপুস্তকে? পরবর্তী জীবনে তাঁরা এটাকে হিব্রু হরফ ভাববেন না তো? বানান ভুল যেমন গোলমেলে, বানান ভেদও কম গোলমেলে নয়।

স্থান-কাল-পাত্র ছাড়াও আরও একটা বিষয় লাগে লেখায়-পড়ায়। সেটা কাণ্ডজ্ঞান। তা না থাকলে পরীক্ষার নম্বর কাটা গেল কি গেল না, তা দিয়ে কিছু নির্ধারিত হয় না। সেটা পরীক্ষার্থীর রয়েছে কি না, তা অভিজ্ঞ পরীক্ষকের চোখ এড়ায় না। ফলে ওভারঅল ইম্প্রেশন বলে একটা ব্যাপার থাকে। পরীক্ষার হলে দ্রুত উত্তর লিখতে গিয়ে কেউ যদি দু-এক জায়গায় কলম হড়কান, তা হলে কি নম্বর কাটা সঙ্গত? আর যে পরীক্ষার্থী আগাগোড়া ‘মুহূর্ত’-কে ‘মূহুর্ত’, ‘ধরন’-কে ‘ধরণ’ আর ‘ধারণ’-কে ‘ধারন’ লিখে আসছেন, তাঁকে ছাড় দেওয়া উচিত? বানান ভেদের দোহাই দিয়ে কি তিনিও পার পেয়ে যাবেন? সে তো ভারি গোলমেলে ব্যাপার!

তা হলে কি ধরে নেব যে, প্রথমে বানান ভুলে নম্বর কাটা হবে না— নিদান দেওয়ার পরে সর্বত্র ট্রোলড হয়ে বানান ভেদের প্রসঙ্গ তুলে ড্যামেজ কন্ট্রোলে নেমেছে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ। তা হলেও বাপারটা গোলমাল-মুক্ত হয় না। বিলাই-মেকুর বিভ্রাট থেকে মুক্তি পাওয়া অত সহজ নয়। বানান ভাষা-কাঠামোরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ— লেখ্য আর কথ্যের সংযোগস্থল। সেটাকে ঘাঁটালে কী ঘটতে পারে আর পারে না, তা অনুমান করতে বসলে ‘ভিরমি’ খেতে হবে (নাকি ‘ভির্মি’ খেতে হবে?)। না হলে বাংলার ‘বা’, চানাচুরের ‘না’ আর লিমকা-র ‘ম’— এই তিন মিলিয়ে ‘বানাম’ লিখে মাতালের প্রলাপের মধ্যে কাটাতে হবে ভবিষ্যৎ।

প্রতীকী ছবি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement