সাফাইকর্মীদের ‘ধাঙড়’ বলা হয় কেন?” প্রশ্নটা করলেন ভিকি দাস। খন্না সিনেমার পাশে অরবিন্দ সরণির উপর পুরসভার আবাসন, সাফাইকর্মীদের জন্য। লোকের মুখে ‘ধাঙড় বস্তি’। হরিজন সমিতির অফিসে বসে ভিকি বলছিলেন, “এই নামে কোনও জাতি বা বর্ণ তো নেই, তা হলে ধাঙড় বলা কেন? কেন বলা হয় ‘চুরি-চামারি?’ চামার জাতির মানুষরা বংশানুক্রমে করে চলেছেন এই শহরকে সাফসুতরো রাখার কাজ। তাঁদের সঙ্গে একটা অপরাধ জোড়া কেন?” পার্ক সার্কাসের চার নম্বর বস্তির রবিরাম দাস অবশ্য দাবি করলেন, নিজের ‘চামার’ পরিচয় নিয়ে গর্বিত। তাঁর দাবি, চামাররা চামড়ার ব্যবসা করে পয়সা করেছে, পড়াশোনা করেছে। নিজস্ব পরিচয় গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। তাতে উচ্চবর্ণের চোখ টাটায় বলে ‘চুরি-চামারি’ শব্দবন্ধটি বলে মানহানি করতে চায়। তবে তিনি বিরক্ত ‘হরিজন বস্তি’ লেখা পুরসভার বোর্ডে, যা ঝুলছে রাজাবাজারের কেশবচন্দ্র সেন স্ট্রিটে। রবি মনে করিয়ে দিলেন, ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট ‘হরিজন’ শব্দটি ‘অপমানজনক’ শব্দ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তবু গ্রামে উচ্চবর্ণের অত্যাচার কলকাতায় নেই বলে এ শহর তাঁদের পছন্দ।
বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা শ্রমিক, যাঁরা কলকাতার বস্তিবাসীদের একটা বড় অংশ, তাঁদের সঙ্গে বাঙালি সমাজ বরাবরই দূরত্ব রেখেছে। অতিমারিতে বেড়েছে সামাজিক ব্যবধানও। যদিও এ শহরের সাফাই, আবর্জনা সংগ্রহ, নর্দমা পরিষ্কার, বাড়ি সাফসুতরো করেন এই অতিথি শ্রমিকরাই— বিশেষত দলিত ও মুসলিম মজুররা। শতাধিক বছর ধরে কলকাতা কর্পোরেশন, সরকারি হাসপাতালের সাফাইকর্মী মানেই বিহার থেকে আসা চামার, মুচি, হাঁড়ি, ডোম বা উত্তরপ্রদেশের হেলা সম্প্রদায়ের মানুষ। কলকাতার মানুষ কী চোখে দেখেছে এই মানুষদের, অজানা নেই। কিন্তু এঁরা কী চোখে দেখেন কলকাতাকে? বামফ্রন্ট ও তৃণমূল, দুই সরকারই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিকে জাতিবিদ্বেষের ঊর্ধ্বে বলে দাবি করেছে। ভিন্রাজ্যের নিম্নবর্ণদের অভিজ্ঞতা কী? ভিকি পড়েছেন বারো ক্লাস অবধি, তাঁদের বস্তির কেউ কেউ গ্র্যাজুয়েশনও করেছেন। কিন্তু স্থানীয় নেতা বা ঠিকাদার তাঁদের সাফাইকর্মীর কাজ ছাড়া কিছু দেন না। বাপ-দাদার পেশা যেন জন্মদাগ। ভিকির বাবা তবু পুরসভার স্থায়ী কর্মী ছিলেন, এখন সব নিয়োগ ঠিকাদারের অধীনে। কাজের নিশ্চয়তা নেই, বেতনের স্কেলও নেই।
নিউ মার্কেটের পিছনে ডোম বস্তির বিশ্বনাথ মল্লিকের পূর্বপুরুষরা একশো বছর আগে এসেছিলেন কলকাতায়। বাঁশের জিনিস তৈরি, শুয়োর পালন, মড়া পোড়ানোর কাজ করতেন। পুরসভার জঞ্জাল বিভাগের কাজেও যুক্ত হন। বিশ্বনাথবাবু পুরসভার স্থায়ী কর্মী, এই বছর অবসর। প্রজন্মের পর প্রজন্ম কেন তাঁরা সাফাইকর্মীর পেশাতেই থেকে গিয়েছেন, তাঁর জানা নেই। রবিরামও বললেন, নিম্নবর্ণের উপর অত্যাচার না থাকলেও, নিম্নবর্ণদের জন্য অতীতে নির্ধারিত পেশায় তাঁদের সীমিত রাখার অভ্যাস আজও রয়েছে। দলিতদের আর্থসামাজিক উন্নতির এটিই সবচেয়ে বড় বাধা।
কলকাতার নিম্নবর্ণের মজুরদের বস্তিগুলি প্রায় সব ক’টাই হিন্দু বসতির থেকে একটু তফাতে, মুসলমান অঞ্চলের আশেপাশেই গড়ে উঠেছে। চামড়ার কাজ, মড়া পোড়ানো, জঞ্জাল সাফাইয়ের মতো কাজে যুক্ত দলিত ও মুসলিম, উভয়ই। রবিরাম নিজে অম্বেডকরপন্থী। তাঁর একটা ছোট কারখানা আছে চামড়ার প্রেসিং-এর। জনাদশেক কর্মীর অধিকাংশই বিহার থেকে আসা চামার সম্প্রদায়ের। ন’মাস কারখানাতেই শোয়া-বসা, পাইস হোটেলে খাওয়া। এমন হাজার দুয়েক কর্মী লকডাউনের সময়ে কাজ করছিলেন চার নম্বর বস্তিতে। আমরা যেমন বলি ‘দিন আনি দিন খাই’, ওঁরা বলেন, ‘রোজ কুঁয়া খুদনা, রোজ পানি পিনা।’ এখন কুয়োতে জল অর্ধেক— কাজ কমে গিয়েছে।
এই শ্রমিকরা খুশি যে, তাঁদের উচ্ছেদের ভয় নেই। পুরসভা এলাকায় ঠিকা টেনেন্সি আইনের জন্য বস্তির জমির মালিকানা সরকারের হয়ে যাওয়ায় এখানে উচ্ছেদের খাঁড়া ঝোলে না। এ শহরে কম পয়সায় টিকে থাকা যায়। ওঁদের নাগালে পুরসভার সুলভ শৌচাগার, বিনা পয়সার জল— ওঁরা বলেন ‘মিঠা পানি’। অন্য অনেক রাজ্যের মতো এখানে জাতিবিদ্বেষের প্রকাশ উন্মুক্ত হিংসা দিয়ে সচরাচর হয় না। কিন্তু আর্থসামাজিক উন্নয়ন, যা পরিযায়ী কর্মীদের স্বপ্ন? বস্তির বাইরে, জাতি-নির্দিষ্ট পেশার বাইরে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন, এমন দৃষ্টান্ত অতি সামান্য। কলকাতার অতিথি শ্রমিক প্রজন্মের পর প্রজন্ম জাতের দাস হয়ে দিন কাটান। ট্যাংরার ‘এসসি-এসটি ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’-এর অফিসে বসে নরেশ মাঝি বলছিলেন, তাঁদের পরিচয় মুছতে দেবে না ব্রাহ্মণরা। ডোম সম্প্রদায়ের সঙ্গে যদি চামার সম্প্রদায়ের বিয়ে হয়, সবার আগে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ব্রাহ্মণ পুরোহিত। কে ছোট, কে বড়, সর্বত্র তা দাগিয়ে দিতে চান। আধুনিক মহানগরে থেকেও কলকাতার অতিথি শ্রমিকরা জাতপাতের শিকল ভেঙে এগোতে পারছেন না।
প্রবন্ধের বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।