পঞ্জিকা বদলাইয়া গিয়াছে। বছরের শেষ সংক্রান্তি পার হইয়া নববর্ষ সমাগত। কিন্তু বর্ষসূচনার এমন রূপ আগে কখনও দেখা যায় নাই, আর কখনও যেন দেখিতে না হয়। সেই রূপ আনন্দের নহে, আতঙ্কের। মিলনের নহে, বিচ্ছিন্নতার। আঁখিপল্লবের এক-সহস্রাংশ পরিমাণ ব্যাস বিশিষ্ট এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরজীবীর দাপটে পৃথিবী স্তব্ধ, গৃহবন্দি। গৃহবন্দি, অবশিষ্ট ভারতের সহিত, বঙ্গবাসীর জীবনও। তাহার হালখাতা, তাহার নূতন পোশাক, তাহার পারিবারিক ও সামাজিক উৎসব, সকলই এই বছরটিতে স্মৃতিচারণার বিষয়মাত্র। এই দুর্যোগ কত দিনে কাটিবে, এই মুহূর্তে কেহ তাহা জানে না। সংক্রমণের ছায়া দূর হইলেও যে দুর্যোগের অবসান হইবে তাহা নহে— অর্থনীতিও প্রবল মন্দার ব্যাধিতে আক্রান্ত। ইতিমধ্যেই বিশ্ব জুড়িয়া যে বিপুল আর্থিক সঙ্কটের সূচনা হইয়াছে তাহা শেষ অবধি কোন অতলে পৌঁছাইবে, আমাদের জীবনে তাহার কী পরিমাণ অভিঘাত আসিয়া পড়িবে, সেই আঘাতের প্রভাব কত দিন স্থায়ী হইবে, এই সকল প্রশ্নের উত্তর এখন ভবিষ্যতের গর্ভে, যে ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। ১৪২৭ বঙ্গাব্দের নববর্ষে যেন নিদারুণ সত্য হইয়া উঠিয়াছে অর্ধ শতাব্দী অতিক্রান্ত বাংলা গানের পঙক্তি: এ কোন সকাল, রাতের চেয়েও অন্ধকার।
কিন্তু দুর্যোগ, তাহা যত ভয়ানকই হউক, কখনও শেষ কথা বলিতে পারে না। মানুষের ইতিহাস চিরকাল তমসা হইতে জ্যোতির পথ খুঁজিয়াছে, মৃত্যুর সম্মুখে দাঁড়াইয়া অমৃতের সন্ধান করিয়াছে। কোথায় আলো, অমৃতকলসই বা কোথায়, তাহা না জানিলেও দমিয়া যায় নাই, উত্তরণের উপায় সন্ধানই মানুষের কাজ। এই বিপদের আবর্তে দাঁড়াইয়া দেশ ও দুনিয়ার সহিত বঙ্গসমাজকেও সেই কাজে নামিতে হইবে, নিজেকে এবং অন্য সকলকে বিপদ হইতে সুরক্ষিত রাখিবার ব্রত পালন করিতে হইবে, সঙ্কট অতিক্রম করিয়া সমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হইবার প্রস্তুতি করিতে হইবে। কাজটি কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নহে। তাহার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন সংহতি ও সহমর্মিতা। বস্তুত, এই দুইয়ের পারস্পরিক সম্পর্ক অতি গভীর। প্রতিটি ব্যক্তির নিরাপত্তা ও সুস্থতা কী ভাবে অন্য সকলের উপর নির্ভর করে, গত কয়েক সপ্তাহে সংক্রমণের মোকাবিলা করিতে করিতে আমরা তাহা নূতন করিয়া শিখিয়াছি। উপলব্ধি করিয়াছি: নিজেকে রক্ষা করিবার জন্য যে আচরণবিধি প্রত্যেক নাগরিককে অনুসরণ করিতে বলা হইতেছে, তাহা অন্যের সুরক্ষার জন্যও জরুরি। এই বাস্তববোধ হইতে যে সহমর্মিতা জন্ম লয় তাহাই সত্যকারের সংহতিকে প্রসারিত করিতে পারে। তাহা উপর হইতে নায়কনায়িকাদের বক্তৃতাযোগে আরোপিত সংহতি নহে, সমাজজীবনের নিজস্ব প্রয়োজন হইতে সঞ্জাত সংহতি।
আরও পড়ুন: সামনে কঠিন পথ, প্রশাসনের মানবিক মুখ জরুরি
ভরসার কথা, তেমন সহমর্মী সংহতির নানা লক্ষণ এই সমাজে প্রতিনিয়ত মিলিতেছে। মনে রাখা আবশ্যক যে, তাহার পাশাপাশি অহরহ মিলিতেছে কাণ্ডজ্ঞানহীন এবং অবিবেকী ক্ষুদ্রস্বার্থপরতার বহু বিপজ্জনক এবং লজ্জাকর নিদর্শনও। কিন্তু সেই অন্ধকারের ছায়ায় শুভবুদ্ধির আলোকচিত্রগুলি যেন নাগরিকের অনুসন্ধানী দৃষ্টির অগোচর না থাকিয়া যায়। অন্য দেশের এবং অন্য রাজ্যের সহিত এই পশ্চিমবঙ্গেও এমন বহু মানুষের সন্ধান মিলিতেছে, যাঁহারা এই ক্রান্তিকালে নিজের এবং অন্যের মঙ্গলবিধানের জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করিতেছেন, অনেকেই সাধ্যাতীত কাজ করিতেছেন। তাঁহাদের সামাজিক স্বভাবই তাঁহাদের সেই ব্রত পালনের প্রেরণা দিয়া চলিয়াছে। প্রচলিত আচার ও আচরণের বাহিরে নিক্ষিপ্ত এ বারের নববর্ষের দিনটির যদি কোনও সার্থকতা থাকে, তবে তাহা এই স্বাভাবিক সামাজিকতার উদ্যাপনে। নাগরিকরা আপন গৃহকোণে সংযত থাকিয়া এই সর্বমঙ্গলের সাধনায় ব্রতী হইলে দুর্যোগের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই সফল হইবে। জয় হইবে মানবসমাজের।
আরও পড়ুন: ছাড় নাই