প্রতীকী ছবি।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কর্মীদের বেতনের একটি অংশ— মোট বেতনের অতি সামান্য অংশ— অতঃপর তাঁহাদের কর্মকুশলতার উপর নির্ভর করিবে, সংবাদটি অন্তত আংশিক ভাবে আশাজনক। যত ক্ষণ অবধি কাজের সহিত বেতন সম্পর্কহীন হয়, তত ক্ষণ কর্মীদের সদিচ্ছার উপর নির্ভর করা ভিন্ন উপায়ান্তর থাকে না। সদিচ্ছা অতি মহৎ বস্তু, সন্দেহ নাই— কিন্তু তাহার ভরসায় একটি গোটা ব্যবস্থাকে ছাড়িয়া দেওয়া বিপজ্জনক। সেই বিপদের বহুবিধ প্রমাণ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির দিকে তাকাইলেই মিলে। গ্রাহকদের সহিত ব্যবহারই হউক বা অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ, কোনও বিষয়েই কর্মীদের সদিচ্ছার সুফল প্রত্যক্ষ হয় নাই। তাঁহারা যদি জানেন যে তাঁহাদের বেতনের অন্তত একটি অংশ নির্ভর করিবে তাঁহাদের কাজের উপর, তবে আর তাঁহাদের সদিচ্ছা নহে, প্রণোদনার দ্বারা চালিত হইবার মৌলিক ধর্মটির উপর ভরসা করিলেই যথেষ্ট হইবে। এক্ষণে একাধিক প্রশ্ন থাকিয়া যায়। প্রথমত, কর্মী সংগঠনগুলির সহিত আলোচনায় যে ১৫ শতাংশ বেতনবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত হইল, শুধুমাত্র তাহার একটি অংশ কর্মকুশলতার ভিত্তিতে নির্ণীত হইবে কেন? সম্পূর্ণ বেতনই কি কাজের গুণগত মান দ্বারা নির্ধারিত হওয়া উচিত নহে? দ্বিতীয়ত, শুধু ব্যাঙ্ক কেন, অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই বা একই নিয়ম প্রযোজ্য হইবে না কেন?
আরও বড় প্রশ্ন হইল, কর্মীদের বেতনবৃদ্ধি কি সংস্থার লাভ-নিরপেক্ষ হইতে পারে? কোনও প্রতিষ্ঠান লাভ করিতে পারিলে তবেই তো কর্মীদের তাহার অংশ দেওয়ার প্রশ্ন উঠে। এই অতিমারিলাঞ্ছিত সময়ে তো বটেই, তাহার পূর্ব হইতেই ভারতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি ধুঁকিতেছে। এই অবস্থায় কর্মীদের বেতন বাড়াইবার অবকাশ থাকে কি? আরও প্রশ্ন, বেতনবৃদ্ধির সহিত মূল্যস্ফীতির হারেরও সংযোগ থাকা বিধেয় নহে কি? এখন ভারতে মূল্যস্ফীতির হার অতি কম। এই অবস্থায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কর্মীদের ১৫ শতাংশ বেতনবৃদ্ধির যৌক্তিকতা খুঁজিয়া পাওয়া ভার। বরং আশঙ্কা হয়, কর্মকুশলতার নিরিখে বেতনবৃদ্ধি ইত্যাদি কথার কথা মাত্র— পূর্বে যেমন ছিল, পরেও তাহাই থাকিবে; অর্থাৎ কর্মী সংগঠনগুলির দর কষাকষির ক্ষমতা, এবং বেতনবৃদ্ধির রাজনৈতিক তাৎপর্যের উপরই নির্ভর করিবে বেতন বাড়াইবার সিদ্ধান্ত। তাহাতে অনেকেরই লাভ। ক্ষতি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির। ক্ষতি গ্রাহকের। এবং অতি অবশ্যই, ক্ষতি ভারতীয় অর্থব্যবস্থার। আশঙ্কা হয়, সিদ্ধান্তগ্রহণের প্রক্রিয়ায় এই পক্ষগুলির স্বার্থরক্ষা করিবার মতো কেহ উপস্থিত নাই। জনগণ যাঁহাদের ভোট দিয়া নিজেদের স্বার্থরক্ষার কাজে নিযুক্ত করিয়াছেন, তাঁহারা সেই দায়িত্ব লইতে অনিচ্ছুক।
কর্মীদের সম্পূর্ণ বেতনও যদি কর্মকুশলতার নিরিখে নির্ধারিত হয়, তাহাও শেষ অবধি অকিঞ্চিৎকর পদক্ষেপ হইয়া থাকিবে, যদি না এই রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলির চলনে কাঠামোগত পরিবর্তন হয়। ব্যাঙ্ক, বিমান সংস্থা ইত্যাদি পরিচালনা করা সরকারের কাজ হইতে পারে না। অস্বীকার করা চলিবে না, কিছু ক্ষেত্রে নিগম প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে— কিন্তু নিয়ন্ত্রণের রাশ শেষ অবধি থাকিয়া গিয়াছে সরকারেরই হাতে। ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলিকে শেষ অবধি রাজনৈতিক (নেতাদের) লাভের শর্ত অনুসারেই চলিতে হয়। কোনও অযোগ্য ঋণগ্রাহকের মাথায় যদি তাবড় নেতার আশীর্বাদী হাত থাকে, তবে কর্মীর শত কুশলতাও তাঁহার ঋণপ্রাপ্তি ঠেকাইতে পারিবে না। এই ব্যবস্থাটি ভাঙা প্রয়োজন। সরকার চাহিলে এই প্রতিষ্ঠানগুলির মালিকানা বজায় রাখুক, কিন্তু পরিচালনার দায়িত্বটি সম্পূর্ণ ছাড়িয়া দিক পেশাদারি হাতে। সেখানে কোনও হস্তক্ষেপের অবকাশ রাখা চলিবে না। একমাত্র তবেই এই প্রতিষ্ঠানগুলি কুশলী হইয়া উঠিতে পারে।