জেলা বর্ধমান ও সম্প্রীতির নানা পাঠ

ধর্মীয় সম্প্রীতির সঙ্গে রাঢ়বঙ্গ তথা বর্ধমানের যোগ অতি প্রাচীন। মূলত কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে জীবনযাপনে অভ্যস্ত রাঢ়বঙ্গে আবহমান কাল ধরে এক সম্প্রদায়ের মানুষ অন্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ফসল ফলিয়েছেন। লিখছেন শ্যামলচন্দ্র দাস ধর্মীয় সম্প্রীতির সঙ্গে রাঢ়বঙ্গ তথা বর্ধমানের যোগ অতি প্রাচীন। মূলত কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে জীবনযাপনে অভ্যস্ত রাঢ়বঙ্গে আবহমান কাল ধরে এক সম্প্রদায়ের মানুষ অন্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ফসল ফলিয়েছেন। লিখছেন শ্যামলচন্দ্র দাস

Advertisement
শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:৪৭
Share:

কাটোয়ার গৌরাঙ্গবাড়ির তোরণ। ফাইল ছবি

গণমাধ্যমের দৌলতে সামাজিক নানা সদ্ভাবের ঘটনা নজরে পড়ে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি, সামাজিক সম্প্রীতি রক্ষায় ব্যক্তি বা সমষ্টিগত উদ্যোগের ভূমিকাও নেহাত কম নয়। যেমন খালনায় লক্ষ্মীপূজার জন্যে উরস পিছনো, অশোকনগরে অসাম্প্রদায়িক দুর্গাপূজা ইত্যাদি গণমাধ্যমের সৌজন্যে জেনেছি। পূর্ব বর্ধমানের বহু এলাকায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আবহে দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয়। সে সব জায়গায় প্রায় সব সম্প্রদায়ের মানুষই কাঁধে কাঁধ দিয়ে পুজোর আয়োজন করেন।

Advertisement

তবে ধর্মীয় সম্প্রীতির সঙ্গে রাঢ়বঙ্গ তথা বর্ধমানের যোগ অতি প্রাচীন। মূলত কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে জীবনযাপনে অভ্যস্ত রাঢ়বঙ্গে আবহমান কাল ধরে এক সম্প্রদায়ের মানুষ অন্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ফসল ফলিয়েছেন। সে জন্য গ্রাম্য বা পারিবারিক ঝামেলা বাদ দিলে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তি-সম্প্রীতি বজায় ছিল সেই মধ্যযুগ থেকে।

শুধু কৃষি নয়, এক ধর্মের মানুষকে অন্য ধর্মের সঙ্গে ঐক্যের সুতোয় বাঁধতে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের গুরুত্ব নেহাত কম নয়। ধর্মের দিক থেকে নানা বিভাজন রয়েছে বর্ধমানে—হিন্দু, মুসলিম, শিখ, বৌদ্ধ ইত্যাদি। আবার হিন্দুর মধ্যেও রয়েছে নানা স্তর—শৈব, শাক্ত, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র ইত্যাদি। এই বিভাজন প্রাচীন বা মধ্যযুগেও ছিল, আজও রয়েছে। তুর্কি আক্রমণের সময় সামাজিক এ জাতীয় বিভাজন কিছুটা রক্ষণশীল মূর্তি ধারণ করলেও, পরবর্তীতে চৈতন্যদেবের বর্ধমান জেলার নানা স্থানে আগমন ও বৈষ্ণবীয় ভাব-আন্দোলনের মাধ্যমে সম্প্রীতির বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল। কাটোয়া, শ্রীখণ্ড, কুলীনগ্রামের সঙ্গে চৈতন্যদেবের প্রত্যক্ষ যোগ ছিল। তাঁর ‘মুচি হয়ে শুচি হও যদি কৃষ্ণ ভজ’ ইত্যাদি নীতির কারণে এক দিকে যেমন তৎকালীন বর্ধমান জেলায় বৈষ্ণব ধর্মের প্রসার ঘটেছিল, অন্য দিকে তেমনই তাঁর ও তাঁর অনুগামীদের উদ্যোগে জনজীবন একটা ঐক্যবদ্ধ ভিত্তির উপরে দাঁড়াতে পেরেছিল।

Advertisement

সমাজ জীবনে সম্প্রীতি রক্ষায় বিভিন্ন রীতিরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। প্রথমে আসা যাক সামাজিক ভাবে সম্পর্ক পাতানোর প্রসঙ্গে। কোনও হিন্দু পিতা-মাতার সন্তান একের পরে এক মারা যেতে থাকলে পরবর্তী জীবিত সন্তানকে মুসলিম পরিবারের কাছে ‘বেচে’ বা ‘বিক্রি’ করে দেওয়া হত, খাওয়ানো হত মুসলিম পরিবারের নানা খাবারদাবার। অনেকের বিশ্বাস ছিল, এ ভাবে ‘পর’ করে দিয়ে সন্তানটির মৃত্যুকে আটকে দেওয়া সম্ভব। সংস্কার বা বিশ্বাসে ভর করেই দু’টি আলাদা সম্প্রদায়ের পরিবারের মধ্যে সম্প্রীতি ও আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারত সে কালের গ্রামাঞ্চলে। এ কালের গ্রামাঞ্চলেও এমন সম্পর্ক পাতানো চলে। মুসলিম মায়ের ‘কেনা-ছেলে’ হিসাবে এক জনের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘মিলন’। নামের মধ্যেই ছিল সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্যের আভাস।

শুধু ব্যক্তিনামে নয়, ঐক্যের আভাস ছিল জনপদের নামেও। শুধু হিন্দু সংস্কৃতি নয়, নবাবহাট, আলমগঞ্জ, আলিশা, জাহান্নগর প্রভৃতি স্থাননামে গুরুত্ব পেয়েছিল মধ্যযুগের ইসলামি সংস্কৃতি। মধ্যযুগে মুসলমান সমাজের মানুষজনের নাম বা পদবী যুক্ত হয়েও ইদিলপুর, মহব্বতপুর (এ কালের মেমারি) আমিরপুর, ইসলামপুর, মিসবাপুর, নসরৎপুর, সুলতানপুর, মিরজাপুর, ফরিদপুর, জামালপুর স্থানের নামকরণ হয়েছিল।

এ বার আসা যাক বর্ধমানের জমিদার তথা রাজাদের নাম প্রসঙ্গে। পাঞ্জাবের ‘কপূর’ বংশের অনেক উত্তরসূরীর নামই শিখ আদর্শে প্রদত্ত। এ প্রসঙ্গে আবু রাই, আফতাব চাঁদ নামগুলি স্মর্তব্য। সম্প্রীতির জন্যই সম্ভবত এমন নাম ধারণ। সম্প্রীতি রক্ষার ছাপ রয়েছে মহতাব মঞ্জিল, মোবারক মঞ্জিল, আঞ্জুমান কাছারি ইত্যাদি প্রাসাদ নামেও। এ ছাড়া ছিল আয়েস মহল, দিলারাম ইত্যাদি নামের ঘর বা প্রাসাদ। মহারাজা মহতাবচাঁদ নতুন শিরস্ত্রাণ চালু করেন। তার নাম ছিল ‘বর্ধমান ক্যাপ’। এটি বাইরে ছিল হিন্দুদের টুপির মতো, কিন্তু ভিতরে ছিল মুসলিমদের ‘কুল্লা’র মতো। ইতিহাসবিদদের একাংশ মনে করেন, বাঙালি-শিখ রাজাদের এমন টুপি পরিধান আসলে সম্প্রীতির স্বার্থে।

শুধু রীতি-রেওয়াজ বা পরিধেয়তেই নয়, সাহিত্যও সে কালের বর্ধমানে সম্প্রীতির সুর বেঁধে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। শোনা যায়, তৎকালীন বর্ধমান-মহারাজকে সম্রাট আওরঙ্গজেব নাকি হাতে লেখা কোরানের একটি কপি উপহার দিয়েছিলেন। উর্দু ভাষার ‘চাহার দরবেশ’, ‘সিকন্দরনামা’, ‘মসনবি’ অনুবাদ করিয়ে বিনামূল্যে বিতরণের ব্যবস্থা করেছিলেন রাজা মহতাবচাঁদ। তিনিই উর্দুর ‘হাতিমতাই’ ১৮৬০ সালে অনুবাদ করান সভাস্থ পণ্ডিত মুন্সি মহম্মদিকে দিয়ে, আর ফারসিরটা করিয়েছিলেন একই বছরে গোলাম রব্বানিকে দিয়ে। এই গ্রন্থগুলি দেখে সংশোধন করে দিয়েছিলেন দুর্গানন্দ কবিরত্ন ও তারকনাথ তত্ত্বরত্ন। মীর হাসনের উর্দু কাব্য ‘মসনবি’ অনুবাদ করেন মুন্সি মহম্মদি, গোলাম রব্বানি ও দুর্গানন্দ কবিরত্ন। পারসি ‘সিকন্দরনামা’ অনুবাদ করেন মুন্সি মহম্মদি ও রামতারণ তর্কবাগীশ। আবার মহারাজ মহাতাবচাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা পান বাহির-সর্বমঙ্গলা এলাকার কবি-সাহিত্যিক খোন্দকার সামসুদ্দিন সিদ্দিকী, যিনি রচনা করেন গীতিকাব্য ‘ভাবলাভ’ ও গদ্যগ্রন্থ ‘উচিত শ্রবণ’। বর্ধমানের সংস্কৃতিতে সাহিত্যের মাধ্যমে যে মিলনের সূত্রপাত হয়েছিল, তা চরম উৎকর্ষ লাভ করে কবি নজরুলের হাতে।

তবে সবটাই যে ইতিবাচক এমনটাও নয়। সাম্প্রদায়িক বিরোধ ও দেশভাগের জন্যই বর্ধমানের মাটি বঞ্চিত হয়েছিল বদরুদ্দিন উমর (৫২’-র ভাষা আন্দোলনের প্রামাণিক ও লব্ধপ্রতিষ্ঠ গবেষক), ঔপন্যাসিক হাসান আজিজুল হক প্রমুখের সান্নিধ্য থেকে। আবার জাতীয় কবির স্বীকৃতি দিয়ে নজরুলকেও বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়া হয়।

এখন এই অঞ্চলে শিক্ষা-সংস্কৃতির উন্নতি হচ্ছে। উদার মনোভাবাপন্ন মানুষের সংখ্যাও ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভাবিকালে তা আরও সাম্যবাদী, মানবিক সম্প্রীতিতে সম্পৃক্ত হবেই বলেই বিশ্বাস করি।

লেখক বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার শিক্ষক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement