‘ফ্লু ক্লিনিক’-এর সামনে ভিড়। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ। ছবি: উদিত সিংহ
পৃথিবীর অন্য দেশের মতো ভারতেও করোনা অতিমারির ত্রাস অব্যাহত। তবে অতীতের ভারতবর্ষ একাধিক বার এমন ভয়ানক অতিমারির সম্মুখীন হয়েছিল। উনিশ শতকে ম্যালেরিয়া, কলেরা, প্লেগ ইত্যাদি সংক্রামক রোগ বারবার আঘাত হেনেছে উপমহাদেশে।
বিশ শতকে সব থেকে ভয়ঙ্কর ছিল ‘ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারি’ (১৯১৮-১৯ খ্রিস্টাব্দ)। এই রোগটিও বিশ্বব্যাপী মহামারির রূপ নেয়। কয়েক মাসের ব্যবধানে মূলত দু’টি দফায় এর প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল। এইচ সিনেকার, এডব্লিউসি ক্রসবি, ডব্লিউ ম্যাকনিয়েল প্রমুখ ইতিহাসবিদদের মধ্যে এই রোগের উৎপত্তিস্থল নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এই রোগের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় স্পেনে। তাই একে ‘স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জা’ বলা বলা হয়। যাই হোক, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন, এই সংক্রামক রোগ ১৯১৮ সালের এপ্রিল মাসে ফ্রান্স থেকে আফ্রিকা, এশিয়ায় হয়ে পরের চার মাসের মধ্যে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। মৃত্যুর মাপকাঠিতে বিচার করলে গেলে কোনও কোনও ইতিহাসবিদ একে মধ্যযুগের ইউরোপের ‘ব্ল্যাক ডেথ’ (১৩৪৩-৫০ খ্রিস্টাব্দ) অর্থাৎ প্লেগ মহামারির সঙ্গে তুলনা করেছেন। সারা বিশ্বের প্রায় ১০০ কোটি মানুষ ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হন এবং প্রায় দু’কোটি ১৫ লক্ষ মানুষ মারা যান।
ভারতে এর প্রথম প্রাদুর্ভাব হয় বোম্বাই অধুনা মুম্বই শহরে ১৯১৮ সালের ১০ জুন। দু’মাসের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ে যু্ক্তপ্রদেশ ও পঞ্জাবে। দ্বিতীয় দফায়, অর্থাৎ সেপ্টেম্বর মাসে তা হানা দেয় মধ্য ও উত্তর ভারতের প্রদেশগুলিতে। এই মহামারি ভারতে চরম বিপর্যয় ঘটায়। বিশ্বের অন্য কোনও দেশ এই রোগে ভারতের মতো এত ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। ব্রিটিশ ভারতের তৎকালীন স্যানিটারি কমিশনার একে ‘জাতীয় বিপর্যয়’ আখ্যা দেন। ভারতে এই রোগের প্রকোপে প্রায় এক কোটি আশি লক্ষ মানুষ মারা যান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও এত সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি হয়নি। আরও বিস্ময়কর তথ্য হল, ভারতে ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারিতে মৃতের সংখ্যা ১৮৯৭-১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যার থেকেও বেশি এবং ১৮৯৭-১৯০১ খ্রিস্টাব্দে দুর্ভিক্ষ জনিত মৃত্যুর প্রায় দ্বিগুণ। এ রোগে সংক্রমিত অধিকাংশ মানুষ জ্বর, শ্বাসকষ্ট অথবা নিউমোনিয়ায় মারা যান। কিন্তু সেগুলিকে ইনফ্লুয়েঞ্জা সংক্রমিত মৃত্যু বলেই গণ্য করা হয়েছিল, অন্য কোনও কারণে নয়। ‘কো মর্বিডিটি’-র ধারণা হয়তো তখন অজানা ছিল।
ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারির মতো করোনা অতিমারির প্রাদুর্ভাবও উত্তর, পশ্চিম ও মধ্য ভারতের প্রদেশগুলিতে বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। তবে পূর্ব ভারতও এর ভয়ে কাঁপছে।
পশ্চিমবঙ্গের অন্য মফস্সলের মতো বর্ধমানও আতঙ্কিত, যদিও আক্রান্তের সংখ্যা বেশি নয়, এমন কথাই স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানান হচ্ছে। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায় যে, বর্ধমানের সঙ্গে সংক্রামক রোগ ও মহামারির পরিচয় অনেক পুরনো। কলেরা, বসন্ত ও ‘বর্ধমান জ্বর’, এক সময়ে এখানে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে মহামারি রূপে বর্ধমান জ্বরের প্রাদুর্ভাব হয়। এবং ১৮৭৪ পর্যন্ত তার তীব্রতা বজায় ছিল। পরে এর প্রকোপ কিছুটা হ্রাস পেলেও সংক্রমণের রেশ বজায় ছিল ইংরেজ শাসনের শেষ পর্যন্ত।
বর্ধমান জ্বরের প্রকৃতি নিয়ে বিতর্ক আজও পিছু ছাড়ে না। বিশ শতকের প্রথম পর্বে এটা ম্যালেরিয়া না কালাজ্বর তা নিয়ে চিকিৎসা-বিজ্ঞানীদের মধ্যে তরজা শুরু হয়। বিখ্যাত ইংরেজ চিকিৎসা-বিজ্ঞানী লিওনার্ড রজার্স বর্ধমান জ্বরকে ‘কালাজ্বর’ বলে চিহ্নিত করেন। যদিও এর স্বপক্ষে কোনও প্রত্যক্ষ প্রমাণ দিতে পারেননি। অন্য দিকে, দেশের চিকিৎসা-বিজ্ঞানী উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী নিদানিক ও নমুনার তথ্যের সংখ্যাভিত্তিক প্রমাণ থেকে একে ‘ম্যালেরিয়া’ বলে অভিহিত করেন। ১৮৭০-এর দশকে বর্ধমানে কর্মরত চিকিৎসকেরা (ডাক্তার জেমস এলিয়ট ও ডাক্তার ডেভিস উইলকিস) নিরীক্ষণ করেন যে, কোনও কোনও জায়গায় বর্ধমান জ্বরের চিকিৎসায় কুইনিন ফলপ্রদ হয়ে ওঠে। আবার অনেক স্থানে তার কোনও সুফল পাওয়া যায়নি। এর থেকে বোঝা যায় যে দু’ধরনের জ্বরের প্রাদুর্ভাব হয়েছিল ম্যালেরিয়া ও অ-ম্যালেরিয়া জ্বর (সম্ভবত কালাজ্বর)। বস্তুত বর্ধমানে ম্যালেরিয়া ও কালাজ্বর উভয়েরই প্রাদুর্ভাব হয়েছিল। সম্ভবত ম্যালেরিয়ার প্রকোপ তুলনামূলক ভাবে বেশি ছিল।
ম্যালেরিয়া ও কালাজ্বর আজও বর্ধমানবাসীকে চোখ রাঙায়। সেই সঙ্গে ডেঙ্গি, বার্ড ফ্লু-র হুমকি তো রয়েইছে। জ্বর তখনও ছিল এখনও আছে। নূতন জ্বর, অজানা জ্বর, ম্যালেরিয়া জ্বর, কালাজ্বর, ইনফ্লুয়েঞ্জা জ্বর ও করোনাজ্বর।
বলা বাহুল্য যে, করোনা নিয়ন্ত্রণ করার কোনও যথার্থ চিকিৎসাপদ্ধতি বা প্রকল্প এখনও চিকিৎসকদের হাতে আসেনি। ১৯১৮-এর ইনফ্লুয়েঞ্জার কারণ ও চিকিৎসা সম্বন্ধে কোনও স্পষ্ট ধারণা ছিল না। ব্রিটিশ ভারতে একে থামানোর মতো কোনও পরিকল্পনা দেখা যায়নি, গৃহীত ব্যবস্থা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। তা ছাড়া, অসংখ্য চিকিৎসক যুদ্ধ সংক্রান্ত পরিষেবায় নিযুক্ত থাকার ফলে চিকিৎসকের অভাব ছিল ক্রমবর্ধমান।
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গেও চিকিৎসক ও নার্সের অভাব হেতু এক সঙ্কটের আশঙ্কা উঁকি মারছে। বেশ কয়েক জন চিকিৎক করোনায় আক্রান্ত এবং বেশ কয়েক জন ভিন্ রাজ্যের নার্স এ রাজ্য ছেড়ে নিজেদের রাজ্যে ফিরে গিয়েছেন। আতঙ্কে, অথবা উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে অসংখ্য বেসরকারি চিকিৎসক তাঁদের ক্লিনিক বন্ধ করে দিয়েছেন বলে জানা যাচ্ছে। বর্ধমানের খোসবাগান পাড়ার চিত্রটা এখন সম্ভবত হতাশাব্যঞ্জক। এ বিষয়ে প্রশাসন একটু দৃষ্টি দিলে ভবিষ্যতের সঙ্কটের কিছুটা মোকাবিলা করা যাবে বলে মনে হয়।
বর্ধমান-সহ পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য পরিষেবা দুর্বল ও অবহেলিত বলে মাঝেমধ্যেই অভিযোগ ওঠে। সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে ও নিয়ন্ত্রণে পশ্চিমবঙ্গ পিছিয়ে বলেও অভিযোগ শোনা যায়। প্রতি বছর ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি বা সোয়াইন ফ্লু জনগণকে আতঙ্কিত করে তোলে। এ ধরনের রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থাও অপর্যাপ্ত বলে প্রতীয়মান হয়।
বর্ধমানের করোনা পরিস্থিতি আপাতদৃষ্টিতে সন্তোষজনক মনে হলেও বাস্তবে ছবিটা হয়তো এখনও নজরবন্দি হয়নি। সমস্যা গভীর হওয়ার আগে এর মোকাবিলার জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেওয়া ভাল। আক্রান্তের সংখ্যা হঠাৎ বৃদ্ধি পেলে তাঁদের সম্ভাব্য ন্যূনতম চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার পরিকাঠামো আগেভাগে তৈরি রাখতে হবে। ভারতের কয়েকটি রাজ্য এই অতিমারিকে অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। তাদের পরামর্শ ও পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। শুধু দু’-একটি অগভীর পদক্ষেপ নিয়ে এই লড়াই জেতা যাবে না। সেই সঙ্গে বর্ধমানের মানুষকেও আরও সচেতন হতে হবে। সরকারি স্বাস্থ্যবিধি ও নির্দেশাবলি মেনে চলার ক্ষেত্রে অধিক দায়িত্বশীল হতে হবে।
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক