আক্রান্ত। নিহত অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী রফিদা আহমেদের একটি আঙুল কেড়ে নিয়েছে সন্ত্রাস। ছবি: রয়টার্স।
মঙ্গলবার, ১২ মে। সকালবেলা। সিলেটে যে ব্যাঙ্কে তিনি চাকরি করেন, সেখানে যাওয়ার পথে বাংলাদেশি ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশকে নৃশংস ভাবে কুপিয়ে হত্যা করল সন্ত্রাসীরা। ফেব্রুয়ারিতে অভিজিৎ রায় ও এপ্রিলে ওয়াশিকুর রহমানেরও একই পরিণতি হয়েছিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শাহবাগ আন্দোলন যখন তুঙ্গে, সেই ২০১৩ সাল থেকেই আক্রমণের নিশানা হচ্ছেন ব্লগাররা। ওই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারিই প্রথম আহমেদ রাজিব হায়দার নামে একজন ব্লগার খুন হন। একটা প্রশ্ন তাড়া করে ফিরছে মুক্তমনা মানুষদের: এর পর কার পালা?
এই ব্লগার হত্যার কারণ বুঝতে হলে শুধু ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বা তার একটি অংশের জঙ্গিয়ানার দিকে তাকালে চলবে না। মূলধারার রাজনীতির একাংশের অবক্ষয়টাও বুঝতে হবে। এ দেশের মুসলমানদের প্রথাগত যে সহনশীলতা, তা আজও সমাজের বৃহত্তর অংশের আসল রূপ। কিন্তু গত দেড় দশকে কিছু ভিন্ন প্রজাতির বিষাক্ত উদ্ভিদ শেকড় গেড়েছে এই নরম পলিমাটির দেশে।
রাজিব হায়দারসহ তিন ব্লগারকে হত্যার দায় স্বীকার করে ভিডিয়ো প্রকাশ করেছে আল-কায়দার দক্ষিণ এশিয়া বিভাগ। পুলিশ অবশ্য মনে করে, এ-সবের হোতা দেশের ভেতরই গজানো নতুন সংগঠন: আনসারুল্লাহ বাংলা। রাজিব হত্যার ঘটনায় এই গোষ্ঠীরই একটি শাখার সাত সদস্য গ্রেফতার হয়। সকলেই ছিল সুপরিচিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটির ছাত্র।
বাংলাদেশে ইসলামি রাজনীতির ধারা পুরনো। কিন্তু জঙ্গিবাদের প্রকাশ নব্বই দশকের শেষ দিকে। ১৯৯৯ সালে যশোরে উদীচি সংস্কৃতিক গোষ্ঠী ও ২০০১ সালে ঢাকার রমনা বটমূলে নববর্ষের অনুষ্ঠানে হামলার মধ্যে দিয়েই বাংলাদেশে প্রথম তালিবানি ধাঁচের সন্ত্রাসের আমদানি। আবার নতুন সহস্রাব্দে এসে জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডকে দু’টি পর্বে ভাগ করা যায়: ‘লাদেন’ আর ‘আওলাকি’ পর্ব।
লাদেন পর্বের নেতারা দেশ জুড়ে সংগঠন তৈরিতে মন দিয়েছিল। তাদের সদস্য ছিল মাদ্রাসা ও গ্রাম থেকে আসা মানুষ। লক্ষ্য ছিল সন্ত্রাসের পথে অরাজকতা তৈরি করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল ও শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠা। তাদের মূল কৌশল ছিল বোমাবাজি।
এই ‘লাদেন’ ঘরানার পুরোভাগে থাকা প্রধান দু’টি গোষ্ঠী হল হরকাতুল জিহাদ (হুজি) ও জামায়েতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)। দুইয়েরই উত্থান বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে (২০০১-০৬)। উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোর প্রতি সেই সরকারের নমনীয়তার অভিযোগ শুধু আওয়ািম িলগের নয়। ২০০৭-০৮ সালে বাংলাদেশে একটি সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল। খালেদা-হাসিনা দু’জনকেই জেলে পুরেছিল তারা। দু’জনের বিরুদ্ধেই ছিল নানা অভিযোগ। উগ্রবাদিতাকে আশকারা দেওয়ার অভিযোগ কিন্তু এসেছিল একা বিএনপি’র বিরুদ্ধে।
বিএনপি একদা জেএমবির অস্তিত্ব অস্বীকার করত, আন্তর্জাতিক চাপে পরে তাকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এর কিছু দিন আগে হুজিও নিষিদ্ধ হয়। কিন্তু জঙ্গি দমনের আসল অধ্যায়ের শুরু বিএনপি আমলের পরে, ২০০৭-০৮-এর সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ািম িলগ সরকার সে ধারাকে জোরদার করে। গ্রেফতার ও বিচারের মুখোমুখি হয় অনেক জঙ্গি নেতা। এ ভাবে এই দশকের শুরুর দিকে অনেকটাই থিতিয়ে যায় লাদেনি সংগঠনগুলো।
লাদেনি পর্বের সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে স্বস্তি আসতে পারত। তা ঠেকিয়ে দেয় নতুন ধাঁচের জঙ্গি মতবাদ, যার মূল প্রেরণা আনওয়ার আল-আওলাকি। ইয়েমেনে ঘাঁটি বাঁধা এই নেতা ২০১১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হলেও ভিডিয়ো মারফত তার মন্ত্রণা এখনও পৌঁছচ্ছে নতুন প্রজন্মের কাছে। মার্কিনি বচনে তুখড় বয়ানের সুবাদে দেশে দেশে এ নেতার জুটেছে বহু শিক্ষিত ও শহুরে অনুসারী। বাংলাদেশে অনুসারীদের মধ্যে অন্যতম হিযবুত তাহরির ও আনসারুল্লাহ বাংলা। গোয়েন্দাদের ধারণা, হিযবুত তাহরির দলছুট সদস্যদেরই সৃষ্টি আনসারুল্লাহ বাংলা।
লাদেনি পর্বের তুলনায় আওলাকি গোষ্ঠীগুলোর সদস্য কম। তারা অনেকেই সচ্ছল, শহুরে পরিবারের সন্তান। তাদের মধ্যে মূলধারার পড়ুয়ার সংখ্যা বেশি। তাদের ফেসবুক ও টুইটার বার্তা দেখে আন্দাজ করা যায়, প্রধানত আধুনিক পরিবারের ছেলেমেয়েরাই এদের নেতৃত্বে আছে। এদের ইসলামি পড়াশোনা কতটা গভীর তা নিয়ে সন্দেহের কারণ আছে। মনস্তাত্ত্বিক ভাবে এক ধরনের বিচ্ছিন্ন তরুণ, যারা প্রচলিত সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বীতশ্রদ্ধ, তারাই হয়তো মরিয়া হয়ে বা একঘেয়ে জীবন থেকে বাঁচতে রোমাঞ্চের টানেই এ পথে চলে এসেছে। মনস্তাত্ত্বিক ভাবে লাদেনি গোষ্ঠীর সদস্যদের চেয়ে হয়তো এককালের অনেক চরমপন্থী বাম মতাদর্শীদের সঙ্গেই এদের মিল বেশি।
আওলাকি ও ব্লগার, দু’পক্ষই তরুণ, শহুরে ও শিক্ষিত, প্রচলিত সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে যাদের বিস্তর প্রশ্ন। ব্লগাররা তাঁদের লেখার জোরে একটি গণআন্দোলন ঘটিয়ে ফেললেন: শাহবাগ আন্দোলন। একাত্তরের ঘাতক ও তাদের প্রশ্রয়দাতাদের অন্তর কেঁপেছিল যুদ্ধাপরাধ-বিচারের পক্ষে জনজোয়ার দেখে। তাকে বানচাল করতে তখন বেছে নেওয়া হয় এক নোংরা কৌশল। ঢালাও ভাবে নাস্তিক আখ্যা দেওয়া হয় ব্লগারদের। অনেক মসজিদ মাদ্রাসায় চলে এই প্রচার। অনুগত মিডিয়াও নেমে পড়ে এ কাজে। কিছু নেতা ঘোষণা করে, নাস্তিক নিধন মুসলমানের কর্তব্য। সামাজিক মাধ্যমে নাস্তিক কর্তনের ডাক আসে। সবার আগে সাড়া দেয় আওলাকি মতবাদের দল আনসারুল্লাহ বাংলা। তাদের প্রথম শিকার রাজিব হায়দার।
কিন্তু শাহবাগ আন্দোলন শেষ হয় দু’বছর আগে। নতুন করে ব্লগার হত্যা কেন? গোয়েন্দারা মনে করেন, আল-কায়দা দক্ষিণ এশিয়ায় ফ্র্যাঞ্চাইজি নেটওয়ার্ক বিস্তারের ডাক দেওয়ার পর এ দেশে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে শুরু হয়েছে প্রতিযোগিতা। ব্লগার হত্যার দায় নিয়ে ছড়ানো আল-কায়দার ভিডিয়ো বার্তা সত্য হলে সম্ভবত সেই প্রতিযোগিতায় জিতেছে আনসারুল্লাহ বাংলা।
কিছু শিক্ষিত তরুণের নৃশংস হয়ে ওঠার প্রেক্ষিতটি মনে রাখা দরকার। প্রথমত, ধর্ম বিষয়ে অসহিষ্ণুতা। বাংলাদেশ অন্য অনেকের চেয়ে উদারবাদী হলেও এখানে ইসলামি গোষ্ঠীর আস্ফালনের মুখে সত্তর ও নব্বইয়ের দশকে দাউদ হায়দার ও তসলিমা নাসরিন দেশান্তরী হন। প্রখ্যাত লেখকরা লাদেনি অধ্যায়ে ছুরিকাঘাতের শিকার হন। আওয়ািম িলগেরই এক মন্ত্রী সম্প্রতি ধর্ম প্রসঙ্গে বেফাঁস কথা বলে কেবল পদ হারাননি, এখন জেলে। ধর্ম নিয়ে বিতর্ক হলেই এ সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যে এক ধরনের নির্লিপ্ততা দেখা যায়। ভাবটা এমন— আক্রান্ত ব্যক্তি নিশ্চয়ই কিছু বাড়াবাড়ি করেছিলেন, বুঝে-শুনে না চললে তো এমন হবেই! এককালে ইসলামি গোষ্ঠীগুলোর প্রতিবাদ ছিল তীব্র নিন্দা থেকে বড়জোর গ্রেফতার ও নির্বাসনের দাবি। ওই দাবিতে নীরব সমর্থনের ফল দাঁড়িয়েছে এই যে, আজ যখন উগ্রবাদীরা হত্যার হুমকি দেয়, তখনও বৃহত্তর সমাজে তেমন সাড়া ওঠে না। জঙ্গিরা কাউকে কোতল করলেও প্রগতিশীলদের দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। গোটা সমাজ যেখানে চুপ সেখানে সরকার একা কী প্রতিরোধ করবে? বাংলাদেশ কোন ধরনের দেশ হতে চায় তা দেশের মানুষকেই ঠিক করতে হবে।
এক্ষেত্রে দেশের শান্তিবাদী আলেম-মাওলানাদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম কোন ধরনের আচরণ সমর্থন করে বা কোনটা করে না, এ ব্যাপারে তাঁদের আরও সরব হতে হবে। এরকম করতে গিয়ে অবশ্য জনপ্রিয় ইসলামি বক্তা মাওলানা ফারুকি খুন হয়েছেন। এতে স্পষ্ট হয় যে, ব্লগারদের যারা হত্যা করছে তারা ইসলামের মিত্র নয়। তারা চায় ইসলামের অপব্যাখ্যা ও ধর্মভীরু মানুষের অনুভূতিকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় যেতে। অতএব ইসলামের খাতিরেই সৎ আলেম-মাওলানাদের এগিয়ে আসা উচিত।