যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্যের বিরুদ্ধে ‘হোক কলরব’-এর পর এমন অরাজনৈতিক আন্দোলন শহর বিশেষ দেখেনি। সম্প্রতি কলকাতার এক নামী স্কুলের চার বছরের একটি শিশুর উপর যৌন অত্যাচারের অভিযোগে উত্তাল হয়েছিল দক্ষিণ কলকাতার এক বড় অংশ। প্রায় একই সময় উঠে এল আর একটি স্কুলে সাড়ে তিন বছরের শিশুর ওপর একই রকম অত্যাচারের ‘ঘটনা’, যা নাকি কয়েক মাস আগে হলেও এত দিন ধামাচাপা ছিল। দুই স্কুলেই কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছড়ে পড়ল, এবং সেই অভিযোগের বিহিতের দাবিতে শহরের ব্যস্ত রাস্তায় অভিভাবকরা একাধিক বার অবরোধ করলেন বহুক্ষণ ধরে।
আর সেই অবরোধের হাত ধরেই উঠে এল অন্য একটি বিতর্ক। রাজনীতিবিদদের অনেকেই ঠারেঠোরে, কেউ বা সরাসরি, অভিভাবকদের এই রাস্তা বন্ধ করে চাপ দেওয়ার কৌশলকে সমালোচনা করলেন। মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি না বললেও আইনকে নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতাকে ঘুরিয়ে কটাক্ষ করলেন। জানিয়ে দিলেন, প্রশাসন, পুলিশ নিজের কাজ করছে। রাজনীতির বিপরীত মেরুতে অবস্থান করা বিজেপির মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় সরাসরি বললেন, কোনও ভাবেই রাস্তা বন্ধ করে, বহু মানুষকে অসুবিধেয় ফেলে, এমন আন্দোলন সমর্থন করা যায় না। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যমে সান্ধ্যকালীন তর্ক-প্রতি তর্কের আসরেও অভিভাবকদের এই অবরোধ, মিছিলকে কমবেশি সমালোচনা করা হল। ভাবখানা এমন যে, অভিভাবকরাই যদি অন্যায়-বেআইনি কাজ করেন, তবে তাঁদের বাচ্চারা কী শিখবে!
এই যুক্তিতে কোনও ফাঁক নেই। কিন্তু ফাঁক থেকে গেছে প্রেক্ষাপটে। অভিভাবকরা, যাঁরা তাঁদের সন্তানের নিরাপত্তার দাবিতে রাস্তায় নেমেছেন যাবতীয় কাজকর্ম বন্ধ করে, তাঁরা তাঁদের অভিভাবকদের কাছ থেকে এত দিনে কী শিখেছেন? এখানে, ‘তাঁদের অভিভাবক’ মানে সমাজের অভিভাবক, অর্থাৎ রাজনীতিবিদ। তাঁরা রোজ টেলিভিশনে দেখেছেন, কাগজে পড়েছেন কী ভাবে সাড়ে তিন দশকের বাম সরকার উলটে গিয়েছে তৎকালীন বিরোধী নেত্রীর আন্দোলনে। সেই আন্দোলনে দিনের পর দিন হাইওয়ে অবরোধ, ব্যস্ত ধর্মতলার এক বড় অংশ আটকে মিছিল-সভার মতো কর্মসূচিও ছিল। কিন্তু সে ক্ষেত্রে সামাজিক সমালোচনা দূরে থাক, সারা দেশ থেকে তাবড় নেতৃবৃন্দ সেই অবরোধে শামিল হয়ে তাকে প্রাতিষ্ঠানিক মান্যতা দিয়েছিলেন।
একই ভাবে, বামপন্থী নেতৃত্ব সরকার থেকে সরে যাওয়ার পর বা বিজেপি রাজ্য সরকারে আসার আশাকে উজ্জীবিত করতে একের পর এক মিছিল-অবরোধের কর্মসূচি নিয়েছে। বস্তুত, বন্ধ-এর রাজনীতি নানা আর্থ-সামাজিক কারণে খানিকটা পিছিয়ে যাওয়ার পর এ রাজ্যে অবরোধ আর মিছিলই বর্তমানে জঙ্গি আন্দোলনের অবধারিত হাতিয়ার। ফলে আজ যদি অভিভাবকরা একই ভাবে নিজের শিশুর নিরাপত্তা ও অন্যান্য দাবি মেটানোর জন্য সেই অব্যর্থ দাওয়াইয়ের শরণাপন্ন হন, তাঁদের দিকে কি আঙুল তোলা উচিত? শুধু অভিভাবকরাই নন, যে কোনও দাবি মেটানোর জন্য একই ওষুধের শরণাপন্ন হচ্ছেন অটো চালক থেকে অটো আরোহী, চাকরির দাবিতে টেট পড়ুয়া থেকে শুরু করে টুকতে দেওয়ার দাবি করা ছাত্রছাত্রী— সবাই।
তাই, সাম্প্রতিক অভিভাবক আন্দোলনের দিকে ‘তুমিও ব্রুটাস’ বলে আঙুল দেখানোর আগে রাজনীতিবিদদের এক বার ভাল করে আয়নায় মুখ দেখা উচিত। বোঝা উচিত, কেন রাজ্যে সামাজিক আন্দোলন মিছিল-অবরোধের এঁদো গলিতে এসে আটকে গেল। কারণটা স্পষ্ট। আজকের পশ্চিমবঙ্গে (গত কালও তা-ই ছিল) নিয়ম না ভাঙলে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করলে, কলকে পাওয়া যায় না। এবং এটাই যে নিশ্চিত সাফল্যের একমাত্র উপাদান, তা স্পষ্ট হয়, যখন অবরোধের এক দিনের মধ্যে অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়। অথচ আগের তিন মাস ধরে নাকি তাঁকে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছিল না।
সোজা কথায়, বাম আমল থেকে শুরু হয়ে বর্তমানে আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থার সম্পূর্ণ রাজনীতিকরণ ঘটে গিয়েছে। থানার কনস্টেবল থেকে রাজ্যের শাসক, আমলা— কেউ এর বাইরে নন। ফলে ছোট-বড় রাজনৈতিক দাদা-দিদিরা (এর মধ্যে বিরোধীরাও আছেন, কেন না প্রশাসন দু’পক্ষকেই হাতে রাখতে চায় ভবিষ্যতের কথা ভেবে) যে কোনও ব্যক্তিগত বা সমষ্টির সমস্যায় যে ভাবে প্রশাসনকে এগনোর পরামর্শ (আসলে, আদেশ) দেবেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁরাও নির্দ্বিধায় সেই পরামর্শ মানবেন। এই মডেলের ফলে গণতন্ত্রের মুখোশের মধ্যে একচ্ছত্র স্বৈরতন্ত্র চালিয়ে যাওয়া যায় ঠিকই, কিন্তু কখনও কখনও ফাঁক গলে যদি কোনও আন্দোলন বড় আকার ধারণ করে (যেমন, স্কুলশিশুদের নিরাপত্তার দাবিতে সাম্প্রতিক আন্দোলন), তখন তাকে আর সামাল দেওয়া যায় না। তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে সাজানোগোছানো দাদাগিরি। বামপন্থীরা ক্ষমতা হারিয়ে হাড়ে হাড়ে শিখেছেন, তৃণমূল কংগ্রেসিরাও যত তাড়াতাড়ি শেখেন, তত মঙ্গল। তত দিন মিছিল, অবরোধে আটকে থাকাটাই আমাদের ভবিতব্য।