চূড়ান্ত তালিকা তখনও প্রকাশ হয় নাই। আশঙ্কা ছিল, তালিকায় স্ত্রী’র নামটি উঠিবে কি না। আশঙ্কা সত্য হইয়াছে। স্ত্রী ‘দেশহীন’ হইয়াছেন। কিন্তু শঙ্কিত ছিলেন যিনি, সেই স্বামীটি আর নাই। তালিকা প্রকাশের পূর্বেই নাগরিক পঞ্জি লইয়া প্রচণ্ড উদ্বেগে তিনি আত্মঘাতী হইয়াছেন। স্বামী-স্ত্রী’র ছোট সংসার ভাসিয়া গিয়াছে। ইহা শুধুমাত্র একটি পরিবারের কাহিনি নহে, কয়েক লক্ষ পরিবারের। অসমের নাগরিক পঞ্জি এক ধাক্কায় যাহাদের ভাঙিয়া টুকরা করিয়াছে। কোথাও সন্তানের নাম উঠিয়াছে, মায়ের নাম উঠে নাই। কোথাও পুরা পরিবারের নাম উঠিয়াছে, অথচ পরিবারের কর্তা জায়গা পান নাই। কোথাও আবার বিচ্ছেদ আসন্ন স্বামী-স্ত্রী’র মধ্যে। অথচ দেশে যুদ্ধ লাগে নাই, পরিবারগুলিতে একযোগে রাতারাতি অশান্তিও পাকাইয়া উঠে নাই। এতৎসত্ত্বেও জানিতে এবং মানিতে হইতেছে অচিরেই মা তাঁহার সন্তান হারাইবেন, স্বামী স্ত্রীকে, বধূ তাঁহার বাবা-মা’কে, অথবা ঠাকুর্দা নাতি বা নাতনিটিকে। নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে ইঁহারা ব্যর্থ। সুতরাং, ধরিয়া লইতে হইবে, কোনও এক কালে তাঁহারা অবৈধ ভাবে এই দেশে অনুপ্রবেশ করিয়াছেন। এর পর তাঁহাদের কী হইবে? কোথায় পাঠানো হইবে? আদৌ কি কোনও দিন ভাঙা পরিবারগুলির পুনর্মিলন সম্ভব? উত্তর নাই।
বস্তুত এই নিরুত্তর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের চিহ্নই এখন দেশ জুড়িয়া। অ-নাগরিকদের সংখ্যাটি, উনিশ লক্ষ, লইয়া বিস্তর চর্চা হইতেছে। যে চর্চাটি হইতেছে না, অথচ হওয়া উচিত ছিল— পরিবারগুলির কী হইবে, যাহাদের এক বা একাধিক সদস্য ‘দেশহীন’ চিহ্নিত হইলেন? এক দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ার হদিস মিলিতেছে, কিন্তু জানা যাইতেছে না, যে মা এইমাত্র জানিলেন তাঁহাকে ঘর ছাড়িয়া চলিয়া যাইতে হইবে, তিনি আর কোনও দিন সন্তানের মুখ দেখিতে পাইবেন কি না, এমন আশঙ্কায় ভুগিতেছেন আরও কয়েক লক্ষ। তাই, রাষ্ট্রের নিশানা এখানে ব্যক্তিবিশেষ বা সম্প্রদায় বলিলেও পুরা বলা হয় না। রাষ্ট্রের নিশানায় পড়িতেছে পরিবার, সম্পর্ক, পারস্পরিক নির্ভরতার প্রাত্যহিক অস্তিত্ব। কাশ্মীরেও অনুরূপ অবস্থা। সেখানে নাগরিক পঞ্জি নহে, জঙ্গি-সেনা সংঘর্ষ উপত্যকাকে অর্ধ-বিধবাদের বাসভূমি বানাইয়াছে। রাতের অন্ধকারে সেনা তুলিয়া লইয়া গিয়াছে কাহারও স্বামী, সন্তান, পিতাকে। তাঁহারা ফেরেন নাই। বৎসর ঘুরিয়াছে, মৃত্যুর বার্তাটিও আসে নাই। ৩৭০-পরবর্তী জমানাতেও নাকি একই ছবি। অশান্তি পাকাইতে পারেন, শুধুমাত্র এমন সন্দেহে রাতারাতি লইয়া যাওয়া হইতেছে বহু নাগরিককে। তাঁহারা ফিরিবেন কি?
দেশে মানবতাবাদের মৃত্যু ঘটিতেছে প্রতি মুহূর্তে। কিন্তু নাগরিক সমাজ চুপ। অথচ, রাষ্ট্র নিরাপত্তা প্রদানে ব্যর্থ হইলে, সুসংহত, সচেতন নাগরিক সমাজেরই সর্বপ্রথম অগ্রসর হইবার কথা, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়িয়া তুলিবার কথা। দুর্ভাগ্য, এই ক্ষেত্রে এখনও তাহা অ-দৃশ্য। দেশছাড়াদের এবং তাঁহাদের পরিবারের পরিণতি কী হইবে, কত দ্রুত মামলাগুলির নিষ্পত্তি হইবে— এত সব জটিল প্রশ্ন তাঁহারা একযোগে তুলিতেছেন না। মুখে কুলুপ আঁটিয়াছেন। আশ্চর্য লাগে, রাজনীতির কোন মহৌষধের পরিণতি এমন ভয়াবহ মৌন! তবে কি, আগুনের আঁচ সরাসরি তাঁহাদের গায়ে, বলা ভাল, পরিবারের গায়ে না লাগিলে এই মৌন ভঙ্গ হইবার নহে?