সংসারের হাল ধরতে স্বনির্ভর গোষ্ঠীতে কাজ। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম
এই তো সেদিনের কথা। তারিখটা ৮ই অগস্ট। চমকে উঠেছিলান খবরটা দেখে! অশালীন মন্তব্যের প্রতিবাদ করায় এক ছাত্রীর মাথার উপর দিয়ে বাইক চালিয়ে দিয়েছে দুষ্কৃতীরা। উত্তরপ্রদেশের সুলতানপুরে। অভিযোগ, পুলিশ ছিল দর্শকের ভুমিকায়। এই ২০১৯ সালে! ভাবা যায়!
ভাবতে ইচ্ছে করে না ঠিকই। কিন্তু, পরের পর ঘটনা ভাবতে বাধ্য করে আমাদের। নারী-সুরক্ষা নিয়ে কত প্রশ্ন জাগে মনে। নারী-সুরক্ষা, শুনতে ভাল। সদ্য দেশ জুড়ে যথোচিত মর্যাদায় উদ্যাপিত হল স্বাধীনতা দিবস। স্বাধীনতার সাত দশকেরও বেশি পার করে প্রাপ্তবয়স্ক এবং প্রাপ্তমনস্ক এই গণতন্ত্র নারীর অধিকার রক্ষায় কতটা সফল? দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় আটচল্লিশ শতাংশ নারী। তাঁরা শারীরিক ও মানসিক ভাবে ঠিক কতটা স্বাধীন নিজ নিজ পরিবারে, কর্মক্ষেত্রে, সমাজে, সর্বোপরি নিজের দেশে, সেটা জানা ভীষণ জরুরি। তথ্যনিষ্ঠ থাকলে কিন্তু এ কথা বলা যাবে না, “প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা...”। প্রশ্নগুলো আসলে জটিল, আর উত্তরও বহুমুখী।
আজও মেয়েরা স্বাধীন ভাবে সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার যে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, তার আইনগত ভিত্তি কিন্তু স্থাপিত হয় ব্রিটিশ শাসকদের হাতেই। ১৮২৯-এর ৪ ডিসেম্বর লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক আইন করে বন্ধ করলেন সতীদাহ প্রথা। সফল হল রাজা রামমোহন রায়ের ঐতিহাসিক লড়াই। সেই সঙ্গে রচিত হল ভারতের নারী স্বাধীনতার ইতিহাসে প্রথম অধ্যায়টি। আর একটি মাইলফলক পেরনো গেল ‘দ্য হিন্দু উইডোজ় রিম্যারেজ অ্যাক্ট, ১৮৫৬’-র দৌলতে। সেই আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তাঁরা দেখিয়ে দিলেন বৈদিক হিন্দুধর্মের সনাতন গ্রন্থ বেদে সতীদাহের উল্লেখ নেই। বরং স্বামীর মৃত্যুর পরে নারীর পুনর্বিবাহের কথাই বলছেন প্রাচীন বৈদিক ঋষিরা (অথর্ব বেদ, ১৮।৩।১ ও ১৮।৩।২ সূক্ত)। লক্ষ্যনীয় যে, মেয়েদের অবদমিত করে রাখার সমস্ত কলাকৌশল সফল ভাবে প্রয়োগ করতে পুরুষশাসিত সমাজ ধর্মের দোহাই আগেও দিত, এখনও দেয়। মেয়েদের অক্ষর পরিচয়টুকুও যাতে না হয়, সেদিকেও অতীতে সজাগ দৃষ্টি ছিল সমাজের। কারণ ‘ওরা যত বেশি জানে, তত কম মানে। সামাজিক অনুশাসনকে ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে নারীর স্বাভাবিক প্রবৃত্তিকে দমন করা এবং ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করার ইতিহাস সব ধর্ম সম্প্রদায়েই কম বেশি আছে। পাশ্চাত্য দেশেও এর খুব একটা হেরফের যে ছিল না, সিমোন দ্য বোভয়ারের ‘দ্য সেকেন্ড সেক্স’ বইটি তার প্রমাণ।
১৯৫৬ সালে পুরুষদের বহুবিবাহ রোধে আইন প্রণয়ন হয়। এর মাধ্যমে মেয়েদের সাংসারিক জীবনে কিছুটা হলেও স্থিতি আসে। যদিও মুসলিম মহিলারা এর সুফল পাননি। ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট তিন তালাক প্রথাকে অসাংবিধানিক বলে রায় ঘোষণা করে। এই রায় কিন্তু সহজে আসেনি। সায়রা বানো, আফরিন রহমান, গুলশন পারভিন, ইশরাত জাহানদের দীর্ঘদিনের লড়াইয়ের ফলশ্রুতি এই ঐতিহাসিক রায়।
স্বাধীন ভাবে বাঁচতে গেলে মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন একান্ত ভাবে প্রয়োজন। ১৯৫৬ সালের হিন্দু উত্তরাধিকার আইনকে সংশোধন করে ২০০৫ সালে সুপ্রিম কোর্ট পৈত্রিক সম্পত্তিতে মেয়েদের অধিকারের বিষয়টিকে সুনিশ্চিত করে। যদিও এই আইন পরিবারের মালিকানাধীন কৃষিজমির উপরে মেয়েদের অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় প্রকাশ: ভারতে কৃষিক্ষেত্রে শ্রমদান করেন ৪২ শতাংশ মহিলা। কৃষিজমির ৮৩ শতাংশ উত্তরাধিকার সুত্রে প্রাপ্ত হন পরিবারের পুরুষ সদস্যরা। অন্য দিকে মেয়েদের ভাগ দুই শতাংশেরও কম। দেখে নেওয়া যাক আরও কিছু সংখ্যাতত্ত্ব। বিশ্ব ব্যাঙ্কের ২০১৮ সালের ‘Women in India’s Economic Growth’ শীর্ষক একটি রিপোর্ট বলছে ‘India ranks 120 among 131 countries in female labor force participation rates…’। এ-ও বলা হয়েছে, দ্রুত নগরায়নের ফলে গ্রামের মহিলা ঠিকা শ্রমিকেরা অতি দ্রুত কাজ হারাচ্ছেন শহুরে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে না নিতে পেরে। রাষ্ট্রপুঞ্জের ২০১৭ সালের জেন্ডার ইনইক্যুয়ালিটি ইন্ডেক্স (জিআইআই) বলছে, ভারতের স্থান ১৬০টি দেশের মধ্যে ১২৭ নম্বরে। অসংগঠিত ক্ষেত্রে যে-সব মহিলা শ্রম দেন, তাঁরা একই কাজের জন্য পুরুষদের থেকে কম মজুরি পেয়ে থাকেন। প্রতিবাদ করার কোনও উপায় নেই, কারণ তা হলে কাজটি হারাতে হবে। উপরি হিসেবে আছে কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা। এর জন্যও কড়া আইন আছে ভারত সরকারের। কিন্তু, তার যথাযথ প্রয়োগ নেই। আবারও সেই ক্লিশে হয়ে যাওয়া কথাটাই বলতে হয়, ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে...’।
যতদিন নারীর বিচরণ ক্ষেত্র বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে ছিল, ততদিন সে অত্যাচারিত হয়েছে বাড়ির আত্মীয়-পরিজনদের দ্বারা। সেই ট্র্যাডিশন আজও চলছে। সাম্প্রতিক খবরে প্রকাশ, এক আটাত্তর বছরের উচ্চশিক্ষিতা মহিলা আশি পেরনো স্বামীর হাতে নিয়মিত মার খান। এই অবস্থায় তিনি বিচ্ছেদ চেয়ে মহিলা কমিশনের দ্বারস্থ। বীরপুঙ্গব স্বামী একটুও লজ্জিত না হয়ে সংবাদ মাধ্যমে বলেছেন, “কথা না শুনলে মারি...।” এই ভদ্রমহিলার প্রতিবাদ ব্যতিক্রমী। অধিকাংশ মেয়েরা সংসার বাঁচানোর তাগিদে মুখ বুজে অত্যাচার সহ্য করেন। বহু আকাঙ্ক্ষিত পুত্র সন্তান অশীতিপর বৃদ্ধা মাকে রাস্তায় বের করে দিতেও আজ দ্বিধাবোধ করে না। পাত্রপক্ষের দাবি মতো পণ দিতে না পারা, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক, সন্তানহীনতা, অন্য জাতে বা ধর্মে বিয়ে ইত্যাদি হাজারটা কারণ (নাকি অজুহাত?) রয়েছে একটি মেয়ের জীবন শেষ করে দেওয়ার জন্য। গার্হস্থ্য হিংসা রুখতেও কঠোর আইন রয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতির বিশেষ পরিবর্তন ঘটছে না।
কাজের ক্ষেত্র যত প্রসারিত হচ্ছে, মহিলাদের উপরে সংগঠিত হিংসাও বহুমাত্রিকতা পাচ্ছে। স্কুলে, কলেজে, অফিসে, বাসে, ট্রেনে, রাস্তায় কোথাও তাঁরা নিরাপদ নন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা থেকে শুরু করে ইটভাটার মহিলা শ্রমিক— সামাজিক হিংসা সবাইকে একই ভাবে আঘাত করে, আঘাত করে তাঁর নারীত্বে। মেয়েদের মুখে অ্যাসিড ছুড়ে মারার ঘটনা এখন আর আমাদের বিচলিত করে না। কামদুনি থেকে কাটোয়া, বানতলা থেকে পার্কস্ট্রিট, উন্নাও থেকে কাঠুয়া, দিল্লির নির্ভয়া, তালিকাটা ক্রমাগত লম্বা হতে থাকে। ভাবতে লজ্জা লাগে, ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে খোদ জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধেও!
ক্ষমতার অলিন্দে বিচরণ করতে করতে সেই সব জন প্রতিনিধিও কখন যেন পুরুষতন্ত্রের ধ্বজাধারী হয়ে ওঠেন। কোনও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ‘ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে ধর্ষণের’ হুমকি দিলেও প্রশাসন তাঁকে গ্রেফতার করার মতো যথেষ্ট কারণ খুঁজে পায় না। স্বাধীন ভারতে মেয়েরা যে ভাল নেই, নিরাপদে নেই, তা প্রমাণ করবার জন্য আর কত মেয়েকে ধর্ষিতা হতে হবে, আত্মহত্যা করতে হবে, আরও কত মেয়েকে হত্যা করা হবে— তার উত্তর সময় দেবে। তবু এ লড়াই শুধু মেয়েদের নয়, হাজার হাজার বছর ধরে লালিত পুরুষতন্ত্র নামক দৈত্যের বিরুদ্ধে সমস্ত শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের লড়াই। এই সহজ কথাটা আজ না বুঝলে সমূহ বিপদ।
(লেখক সাহিত্যকর্মী, মতামত নিজস্ব)