সম্প্রীতির বাঁধনে বেঁধেছিল মনোহর ফাঁসুড়ে পট

পুরাণ, মঙ্গলকাব্যের বাইরে লৌকিক বিষয় নিয়েও আঁকা হত পট। ছিল রূপকথাধর্মী পটও। সেই পটের গানে মিলনের সুর। নতুন আলোকে পট-পরিচয় করালেন দীপককুমার বড় পণ্ডাপুরাণ, মঙ্গলকাব্যের বাইরে লৌকিক বিষয় নিয়েও আঁকা হত পট। ছিল রূপকথাধর্মী পটও। সেই পটের গানে মিলনের সুর।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০১৯ ০০:১৮
Share:

উদ্ধার: ঘাটালের দাসপুর থেকে ডেভিড ম্যাকাচ্চন সংগৃহীত মনোহর ফাঁসুড়ে পট। ছবিটি ‘পটুয়াজ অ্যান্ড পট আর্ট ইন বেঙ্গল’ বই থেকে নেওয়া।

কলকাতার গুরুসদয় সংগ্রহশালায় পটের কর্মশালা হবে। পটুয়ারা সংগ্রহশালার পুরনো দিনের পট নতুন করে আঁকবেন। ‘বাংলা নাটক ডট কম’এর আয়োজনে এই কর্মশালায় যে যাঁর মতো পট বেছে নিচ্ছেন। সেগুলিই নতুন করে আঁকা হবে। প্রতিটি পটের শিক্ষণীয় বিষয় প্রচার করা হবে। দুই মেদিনীপুর জেলার নামী পটুয়ারা অংশ নিয়েছেন। কিন্তু পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়ার সেরামুদ্দিন চিত্রকরের মন ভার। তিনি তাঁর পছন্দের মনোহর ফাঁসুড়ের পট আঁকতে চান। কত রকমের পট রয়েছে। সেসব বাদ দিয়ে সেরামুদ্দিনের মনোহর ফাঁসুড়ের পটে আগ্রহ কেন? কারণ ছোটবেলা থেকেই বাবা রঞ্জিত চিত্রকরের কাছে ‘মনোহর ফাঁসুড়ে পট’এর কাহিনি শুনে আসছেন। কিন্তু আঁকা হয়নি।

Advertisement

পৌরাণিক কাহিনিকে আশ্রয় করে আঁকা পটের বাইরে রূপকথা নির্ভর কিছু পট এক সময়ে আঁকা হয়েছিল। এর মধ্যে মনোহর ফাঁসুড়ে পট বা মনোহর ফাঁসিরার পট আকর্ষণীয়। কাহিনি অনুযায়ী, মনোহর ফাঁসুড়ের সাত ছেলে আর রূপবতী কন্যা রাহুতি। বৃদ্ধ মনোহর এবং তার ছেলে মেয়েরা বিত্তবান বণিক কিংবা রাজপুত্রদের ভুলিয়ে ঘরে নিয়ে আসত। রাতে রাহুতি অতিথির সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে সবকিছু অপহরণ করত। খুন করা হত অতিথিকে। কিন্তু পট পরিবর্তন হল। তরুণ সওদাগর মানিক দত্ত মনোহরের ফাঁদে ধরা পড়ে। কিন্তু রাহুতি মানিককে খুন করতে এসে বিচলিত হয়। সে রূপবান মানিকের প্রেমে পড়ে। সেই রাতেই দু’জনে ঘোড়ায় চড়ে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু দাদারা বাধা দেয়। তাতে লড়াই বাধে। মনোহর বাড়িতে বসে জাদুবলে সব দেখতে পায়। সে-ও মেয়ে আর মানিককে হত্যা করতে যায়। কিন্তু দেবতার আশীর্বাদে রাহুতি এবং মানিক লড়াইয়ে জয়ী হয়। রাহুতি তার বাবা-দাদাদের হত্যা করে পালায়।

চলতে চলতে ক্লান্ত দু’জনে। এখানে কাহিনি আবার বাঁক নেয়। রাহুতিকে গাছতলায় বসিয়ে মানিক পুকুরে স্নান করতে যায়। পথে দেখা হয় মালিনীর সঙ্গে। মালিনী জাদুমন্ত্রে মানিককে ভেড়া বানিয়ে দেয়। অসহায় রাহুতি পুরুষের ছদ্মবেশে স্থানীয় এক রাজার দরবারে কাজ নেয়। সেই সময় রাজ্যে গন্ডারের উপদ্রব শুরু হয়। রাজা ঘোষণা করেন, গন্ডারকে যে বধ করতে পারবে, তাকে তিনি অর্ধেক রাজত্ব এবং রাজকন্যা দেবেন। রাহুতি গন্ডার হত্যা করে রাজার প্রিয় হয়ে ওঠে। রাহুতি বলে, কালী প্রতিমার কাছে ভেড়া বলি দিয়ে সে রাজকন্যা এবং অর্ধেক রাজত্ব গ্রহণ করবে। কালী পুজোর দিন মালিনীর বাড়ি থেকে মানিক দত্ত-রূপী ভেড়া আনা হয়। ভেড়ার গলা থেকে মালা খুলে নিলে মানিক দত্ত স্বরূপ ফিরে পায়। চোখে জল আসে রাহুতির। সে রাজাকে সব কথা খুলে বলে। এই কাহিনি পটুয়ারা শোনান এই ভাবে, ‘পুরুষ নয় আমি রাহুতি কুমারী, পুরুষ হইয়া আমি নিলাম চাকুরি, রাহুতি বলেন শুন রাজা মহাশয়, ইহার লাগি বাপভাই সবংশে কাটিয়া, দেশান্তরী ইইয়াছি ইহার লাগিয়া, ইহার জন্য যে আমি গন্ডারে মারিয়া, তোমার কন্যা রাজত্ব দিয়ে আমায় দিলে বিয়া, এই দুই কন্যা তুমি উহারে দিবে, তবেত আমার মনে শান্তি জন্মাইবে’। রাজা মানিক দত্তকে রাহুতি এবং তাঁর কন্যা সম্প্রদান করেন। সঙ্গে অর্ধেক রাজত্ব। এর পর পুজোর আয়োজন হয়।

Advertisement

মনোহর ফাঁসুড়ের কাহিনি আসলে সত্যপীরের মাহাত্ম্য প্রচারে গাওয়া হয়। গ্রামবাংলায় সত্যপীর সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের অসাধারণ উদাহরণ। সত্যপীর আর নারায়ণ এক হয়ে গিয়েছেন। মেদিনীপুরের অধ্যাপক-গবেষক অনিমেষকান্তি পাল লিখেছিলেন, ‘রাহুতি এক অচেনা নায়িকা’ (পট ও পটুয়া, ১০ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৩, মেদিনীপুর শিল্পীচক্র)। মনোহর ফাঁসুড়ের গান সংগ্রহের বিষয়ে তিনি লিখেছিলেন, মালিগ্রামের হরেন চিত্রকর প্রথমে স্মৃতি থেকে গান শুনেছিলেন। এ ছাড়াও গান সংগ্রহ করা হয়েছিল পিংলা থানার নয়া এলাকার যতীন্দ্রনাথ চিত্রকর, মালিগ্রামের সন্তোষ চিত্রকর, নন্দীগ্রাম থানার হবিচক গ্রামের গোবর্ধন চিত্রকরের কাছ থেকে। আবার নন্দীগ্রামেরই আমদাবাদ গ্রামের পরেশ পটুয়ার থেকে মনোহর ফাঁসুড়ের গান সংগ্রহ করেছিলেন নৃতাত্ত্বিক প্রবোধকুমার ভৌমিক। অর্থাৎ অবিভক্ত মেদিনীপুরে এই গানের ব্যাপক প্রচার ছিল।

হরেন চিত্রকর এবং পরেশ পটুয়ার গানের বিষয়বস্তু এক হলেও কিছুটা তফাৎ রয়েছে। পরেশের গানে সত্যপীরের মহিমা প্রকাশ পেয়েছে। হরেন চিত্রকরের গানে আছে নারায়ণের স্তুতি। হয়তো কোনও লৌকিক কাহিনি ঘিরেই গড়ে উঠেছে মনোহর ফাঁসুড়ে বা মনোহর ফাঁসিরার গান। যে গানে সত্যপীর বা সত্যনারায়ণের মহিমা প্রচারিত হয়েছে। হরেন চিত্রকরের গানটি ছিল এইরকম, ‘হিন্দুকুলে নারায়ণ মোমিন কুলে পির/দুই কুলে পূজা খেয়ে হয়েছে জাহির/নামের নাহি লেখাজোখা লম্বা লম্বা কেশ/কতদিগে কত মূর্তি ধরে নানা বেশ/নারায়ণ বলে আমি নাম সত্য হব/নারায়ণের পূজা আমি প্রচার করিব’। পরেশ পটিদারের গানটি এরকম, ‘হিন্দুকুলে নারায়ণ মোমিন কুলে পীর/এ দুয়ে মিলি আমি হয়েছি জাহির/একদিন সত্যপীর মনে বিচরিয়া/সিন্ধুরাজা দেশে আমি পূজা নিব গিয়া...’।

এইসব গানে গ্রামবাংলায় হিন্দু-মুসলিম একত্রিত হয়েছেন। পাশাপাশি বসে তাঁরা এই পাঁচালি শুনেছেন। সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ় করতে এইসব গান আলাদা ভূমিকা নিয়েছে। কাহিনির রহস্য বুননে গানের আলাদা আকর্ষণ ছিল। এই কারণেই লোকসংস্কৃতিবিদ তারাপদ সাঁতরা বারে বারে আক্ষেপ করেছেন, ‘রাহুতি ও মদনের প্রেমকাহিনীমূলক দীর্ঘ এই গীতিকাব্য গ্রাম্য পটুয়ারা তাঁদের অঙ্কিত পটের মাধ্যমে সুরেলা কণ্ঠে গ্রামগঞ্জে পরিবেশন করতেন। দুঃখের কথা, পটুয়াদের পটের বিষয়বস্তুর মধ্যে রূপকথার কাহিনী নিয়ে সৃষ্ট এমন অনেক লোকগীতি ছিল যা আমরা ভুলতে বসেছি। সেদিক থেকে গাথা-গীতিকার বিষয়বস্তু নিয়ে রচিত এই পটটি ছিল বাংলার গ্রামীণ-গীতিকাব্যের এক গিরিনির্ঝর বিশেষ’। (তারাপদ সাঁতরা, পটুয়া ও পটচিত্র: মেদিনীপুর, হাওড়া ও চব্বিশ পরগনা, পশ্চিমবঙ্গের পটচিত্র, লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র)।

মনোহর ফাঁসুড়ে ছাড়া আরও কিছু পট ছিল যা কিংবদন্তী বা উপকথামূলক। তারাপদ সাঁতরা এরকম একটি পটের সন্ধান পেয়েছিলেন ইংল্যান্ডের ভিক্টোরিয়া অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে। পটের বিষয়, চার বেহারার পালকিতে সম্ভবত এক রাজকন্যা চলেছেন। পালকির নীচে একটি কুকুর। পরের দৃশ্যে, পালঙ্কে ঘুমন্ত এক রাজকন্যা। তার পা এবং মাথার দিকে প্রহরারত দু’টি বাঘ এবং উদ্যত ফণা দু’টি সাপ। এ হয়তো জিয়নকাঠি মরণকাঠির রাজকন্যা।

সেরামুদ্দিন এঁকে চলেছেন মনোহর ফাঁসুড়ের কাহিনি। বলছিলেন, ‘‘রাহুতিকে সুন্দরী করে আঁকব। মন দিয়ে সাজাব।’’ ওঁর আঁকা রাহুতি, মনোহর ফাঁসুড়ের মাধ্যমে দুই মেদিনীপুরের পটুয়ারা আবার সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির বাঁধন জোরদার করবেন। হারাতে বসা রূপকথার নতুন জগত তৈরি হবে। হারিয়ে যাচ্ছে যে রূপকথা। আক্ষেপ, অভিযোগ বারবারই শোনা যায়। ইউরোপ, আমেরিকায় ছোটদের কাছে রূপকথাধর্মী কাহিনিগুলি পৌঁছে দেওয়ার কাজ চলছে নানা ভাবে। কখনও বই আকারে, কখনও সিনেমার মাধ্যমে। ব্যবসায়িক দিক থেকে সফলও সেই সব উদ্যোগ।

বাংলা পল্লিতে পল্লিতে ছড়িয়ে রয়েছে কত শত রূপকথা, লৌকিক কাহিনি। সে সব নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।

লেখক অ্যাসিস্ট্যান্ট কিউরেটর, গুরুসদয় মিউজিয়াম

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement