প্রতীকী ছবি
আত্মহত্যা সত্যই ‘পাপ’ কি না, তাহার উত্তর ধর্মীয় গুরুরা জানেন। সেই পাপ-পুণ্যের তর্কের ভিতর না ঢুকিয়াও আত্মহত্যা লইয়া একটি সহজ প্রশ্ন তোলা যায়। নিজেকে হত্যা করিবার অধিকার কি কাহারও আদৌ থাকা উচিত? উত্তরটি, ভারতীয় আইনের পরিভাষায়, না। এই দেশে আত্মহত্যা আইনত অপরাধ। কিন্তু ইহাও সত্য যে, স্বেচ্ছায় কেহ এই অপরাধ সচরাচর করে না। অন্য অনেক অপরাধের মতোই এই ক্ষেত্রেও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি তাহাকে সেই দিকে ঠেলিয়া দেয়। সম্প্রতি যেমন ঝাড়খণ্ডে একই পরিবারের চার জন আত্মহননের পথ বাছিয়া লইয়াছেন। অনুমান, ইহার পশ্চাতে পারিবারিক আর্থিক দুরবস্থাই দায়ী। ব্যবসায় ক্ষতির কারণে উপায়ান্তর না দেখিয়া পরিবারটির চার জন প্রাপ্তবয়স্ক আত্মহত্যা করিয়াছেন। ইহাকে ‘অপরাধ’-এর গোত্রে ফেলা যায় কি না, তাহা আলোচনার বিষয়। বিপুল দেনার ভার এবং সামাজিক মর্যাদাহানি— এই দুইয়ের সম্মিলিত চাপ সহ্য করিবার মতো মানসিক জোর অল্প জনেরই থাকে। অন্যদের কাছে সঙ্কটের চটজলদি সমাধান হিসাবে মৃত্যুই একমাত্র পথ বোধ হয়। ঝাড়খণ্ডের পরিবারটির ক্ষেত্রেও ইহাই ঘটিয়াছে।
সমস্যা হইল, এই গণ-আত্মহত্যার ঘটনায় দুই শিশুরও মৃত্যু হইয়াছে। পরিবারের বড়রাই হত্যাকাণ্ডটি ঘটাইয়াছেন। ইহা অপরাধ। জঘন্য অপরাধ। বস্তুত, পারিবারিক সমস্যার কারণে শিশুহত্যার ঘটনা ভারতে ক্রমেই বৃদ্ধি পাইতেছে। কখনও আর্থিক সমস্যা, কখনও স্বামী-স্ত্রীর অশান্তির কারণে শিশুসন্তানটিকে লইয়া আত্মহননের এই প্রবণতা গভীর উদ্বেগের। উদ্বেগ এই কারণে, আর্থিক বা পারিবারিক সমস্যাটিকে সম্যক ভাবে উপলব্ধি করিবার বোধ শিশুর এই পর্যায়ে জন্মায় না। ফলে, মৃত্যুতে সম্মতি দিবার প্রশ্নও ওঠে না। সুতরাং, নানাবিধ সমস্যাকে সামনে রাখিয়া তাহাদের এক রকম বাধ্য করা হইতেছে অকালে পৃথিবী ছাড়িতে। এবং অনেক ক্ষেত্রে হত্যার কাজটি করিতেছেন তাহারই মা-বাবা, যাহারা নাকি সন্তান জন্মের পর হইতেই তাহাকে একটি সুস্থ, সুন্দর জীবন দিবার জন্য দায়বদ্ধ। পরিস্থিতির চাপে তাঁহারা সেই অঙ্গীকার পূরণে ব্যর্থ হইতেই পারেন, কিন্তু সেই ব্যর্থতা একটি শিশুপ্রাণকে হত্যার দোহাই কখনও হইতে পারে না।
প্রকৃতপক্ষে, সপরিবার আত্মহননের সময় পরিবারের শিশুদেরও শামিল করার প্রবণতাটি তাৎক্ষণিক উত্তেজনাপ্রসূত নহে। ইহার গোড়াটি ‘সন্তান বাবা-মায়ের ব্যক্তিগত সম্পত্তি’— এই মানসিকতা হইতে উদ্ভূত। এই দেশে ধরিয়া লওয়া হয়, মা-বাবার ভালমন্দ সমস্ত কিছুর সঙ্গেই সন্তানের ভাগ্যটিও অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ। তাহার যে একটি একক সত্তা আছে, স্বাধীন ভাবে বাঁচিবার এবং জীবনকে উপভোগ করিবার সমস্ত অধিকার আছে, ইহা প্রায়শই অগ্রাহ্য করা হইয়া থাকে। অনেকে আবার সন্তানের নিরাপত্তার প্রশ্নটি তোলেন। উদ্বিগ্ন হন, মা-বাবা না থাকিলে শিশুর ভবিষ্যৎ কী হইবে। প্রশ্নাতীত ভাবেই অভিভাবকদের হারাইলে সন্তানের জীবন সমস্যাসঙ্কুল হইবে। কিন্তু জীবন অন্ধকার হইতে পারে বলিয়া তাহার গোটা জীবনটাই কাড়িয়া লওয়া যায় না। হয়তো যেখানে তাহার অভিভাবকরা ব্যর্থ হইয়া ময়দান ছাড়িয়াছেন, সেখান হইতেই সে জিতিবার মন্ত্র খুঁজিয়া লইল। জীবন তো এমনই।