বক্তৃতা শেষে অমর্ত্য সেন চললেন পরীক্ষা দিতে

বিভূতিভূষণ যখন ইন্টারমিডিয়েট পড়ছেন সেই সময় বরিশালের ব্রজমোহন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হলেন জীবনানন্দ দাশ। লিখছেন সুদীপ জোয়ারদারবিভূতিভূষণ যখন ইন্টারমিডিয়েট পড়ছেন সেই সময় বরিশালের ব্রজমোহন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হলেন জীবনানন্দ দাশ। লিখছেন সুদীপ জোয়ারদার

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০২:৫৩
Share:

এখন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার মরসুম। এই সময়ে পিছনে ফিরে সাহিত্য বা অন্য ক্ষেত্রে বিখ্যাত কিছু বাঙালির এই পরীক্ষার সমতুল পরীক্ষায় বসা এবং সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হওয়ার কথা একটু জেনে নেওয়া যেতেই পারে।

Advertisement

আজকের উচ্চ মাধ্যমিক তার বর্তমান অবস্থায় কিন্তু এসেছে বহু বিবর্তনের পথ ধরে। প্রথমে এর নাম ছিল এনট্রান্স বা প্রবেশিকা। শুরু হয়েছিল ১৮৫৭ সালে। আয়োজক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। এনট্রান্স ব্যবস্থা পরবর্তীতে এক সময় দাঁড়ায় ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েট ব্যবস্থায়। স্নাতক স্তরে যেতে গেলে সেই সময় ইন্টারমিডিয়েটে উত্তীর্ণ হতে হত। অর্থাৎ আজকের উচ্চ মাধ্যমিকের সমতুল ছিল ইন্টারমিডিয়েট। এই পর্যায়ে কিন্তু আমরা আমাদের অনেক বিখ্যাত লোকজনকে পেয়ে যাব।

প্রথমেই বলা যাক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা। সাল ১৯১৪। বনগ্রাম হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে পাশ করে বিভূতিভূষণ কলকাতায় এলেন পড়তে। কোথায় ভর্তি হবেন? নানা কলেজে ঢুঁ মারলেন। বঙ্গবাসী কলেজের পরিবেশ পছন্দ হল না। সেন্ট পলস কলেজ, সিটি কলেজ থেকেও ফিরে এলেন। কারণ, কলেজ যদি বা পছন্দ নেই ফ্রি স্টুডেন্টশিপের ব্যবস্থা। অবশেষে ভর্তি হলেন রিপন কলেজে। এখানে ফ্রি স্টুডেন্টশিপ পেলেন না। তবুও এখানেই রয়ে গেলেন। কারণ, এখানকার মাইনে তখন অন্য কলেজের তুলনায় অনেকটাই কম। ১৯১৬ সাল। রিপন কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করলেন বিভূতিভূষণ। পাশ করে বিএ -তে ভর্তি হলেন ওই কলেজেই।

Advertisement

বিভূতিভূষণ যখন ইন্টারমিডিয়েট পড়ছেন সেই সময় অর্থাৎ, ১৯১৫ সালে বরিশালের ব্রজমোহন স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করে ব্রজমোহন কলেজেই ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হলেন আর এক জন। তিনি জীবনানন্দ দাশ। পরবর্তীতে এই কলেজেই তিনি শিক্ষকতা করবেন কিছু দিন। আপাতত পড়া ইন্টারমিডিয়েটে। ১৯১৭ সাল। এই কলেজ থেকেই প্রথম বিভাগে আইএ পাশ
করলেন জীবনানন্দ।

১৯১৮ সাল। সাহেবগঞ্জ রেলওয়ে হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করে হাজারিবাগের সেন্ট কলাম্বাস কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলেন বনফুল। রেসিডেন্সিয়াল কলেজ। স্থান পেলেন নর্থ ব্লকের হস্টেলে। এখানে পরিচয় হল অমিয় চক্রবর্তীর সঙ্গে। অমিয় তখন বিএ পড়ছেন। পরিচয় হল মুর্শিদাবাদের সন্তান,পরবর্তী কালে ‘কালোঘোড়া’, ‘অনুষ্টুপ ছন্দ’ ইত্যাদি বহু বিখ্যাত উপন্যাসের জনক সরোজকুমার রায়চৌধুরীর সঙ্গে। দু’জনের স্ট্রিম অবশ্য আলাদা। সরোজকুমার আইএ, তিনি আইএসসি। আইএসসিতে বনফুলের বিষয় ছিল অঙ্ক, রসায়নবিদ্যা এবং উদ্ভিদবিদ্যা। স্কুলে থাকতেই সাহিত্যচর্চা শুরু হয়েছিল। এখানেও তার ছেদ পড়েনি। বাংলার অধ্যাপক চারুচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এক দিন ক্লাসে এসে ‘গরু’র রচনা লিখতে দিলেন। বনফুল ছন্দে লিখলেন রচনা। যার কয়েকটা লাইন—‘মানুষ তোমায় বেজায় খাটায়/টানায় তোমায় লাঙলগাড়ি/একটু যদি দোষ করেছ/অমনি পড়ে লাঠির বাড়ি…।’ বনফুলের কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল কলেজে। এই সময় ‘প্রবাসী’তেও ছাপা হল কয়েকটা কবিতা। আর পড়াশোনা? তাও চলল সমান তালে। তবে ভাগ্য বিরূপ। বটানির প্র্যাক্টিকালে অবিশ্বাস্য কম পেলেন। ফল, আইএসসিতে জুটল সেকেন্ড ডিভিসন।

বিখ্যাত সমালোচক, ‘শনিবারের চিঠি’ খ্যাত সজনীকান্ত দাস বনফুলের সঙ্গে একই বছরে অর্থাৎ ১৮১৭ সালে বৃত্তি নিয়ে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেছিলেন দিনাজপুর জেলা স্কুল থেকে। সজনীকান্ত এর পরে আইএসসি পড়ার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। কিন্তু বিপ্লব-বিদ্রোহের কেন্দ্রস্থল কলকাতায় তাঁর পড়া হল না। দিনাজপুর থাকতেই রাজনৈতিক কলঙ্কের ছাপ লেগেছিল গায়ে। পিতা সরকারি কর্মচারী। ভয় পেলেন ছেলেকে কলকাতায় রাখতে। বাঁকুড়া ওয়েসলিয়ান মিশনারি কলেজে সজনীকান্তকে ভর্তি করা হল। থাকার ব্যবস্থা হল সংলগ্ন হস্টেলে। কিন্তু পড়ায় তেমন মন বসল না সজনীকান্তের। কলকাতা ছেড়ে আসার জন্য মনখারাপ। সময় পার হতে লাগল অন্য ভাবে। সজনীকান্ত লিখেছেন, ‘সহপাঠী ও সহবাসী বন্ধুদের মোড়লির কাজ লইলাম।’ তবে ম্যাট্রিকুলেশন পর্যন্ত অধ্যয়নের ভিত্তি ছিল দৃঢ়। তার জেরেই আইএসসি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উচ্চ স্থান পেলেন।

ঢাকা বোর্ড থেকে ম্যাট্রিকে পঞ্চম স্থান পেয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু। ভেবেছিলেন প্রথম হবেন, নিদেনপক্ষে দ্বিতীয়। পঞ্চম হয়ে মনখারাপ হয়ে গেল বুদ্ধদেবের। সাল ১৯২৬। মনে দাগা নিয়েই ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে ভর্তি হলেন বুদ্ধদেব। সমমনস্ক অনেক বন্ধু জুটল। সাহিত্যচর্চা চলল জোরকদমে। বের করলেন হাতে লেখা পত্রিকা ‘প্রগতি’। সাহিত্যচর্চার কারণে পড়াশোনায় অবশ্য বিঘ্ন ঘটল না। তবে ম্যাট্রিকে আশানুরূপ রেজাল্ট না হওয়ায় এ বার পরীক্ষার আগে থাকলেন ‘সুচিন্তিতভাবে চিন্তাহীন, বদ্ধপরিকরভাবে অনিবদ্ধ।’ বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন, ‘কৌতুক এই, সেই তাচ্ছিল্যসাধিত পরীক্ষাতেই আমি পেলাম দ্বিতীয় স্থান-পরন্তু
একটি স্কলার্শিপ।’

কথাকার নরেন্দ্রনাথ মিত্র জন্মেছিলেন ফরিদপুরের সদরদি গ্রামে। সদরদি গ্রামের কাছেই ছিল শহর ভাঙা। ভাঙা হাইস্কুল থেকে ১৯৩৩ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করে নরেন্দ্রনাথ আইএতে ভর্তি হলেন ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে। অভাবের বাড়ি। হস্টেলের খরচ চালাবার সামর্থ্য নেই। নরেন্দ্রনাথকে রেসিডেন্সিয়াল টিউশন জোগাড় করতে হল। নরেন্দ্রনাথের টিউশনিতে সুনাম ছিল না। ছাত্রেরা তাঁকে মানতে চাইত না। ফলে এই সময়ে টিউশনি পড়াতে হল নানা জায়গায়। এ সবের মধ্যে সাহিত্যচর্চা কিন্তু বন্ধ হল না। বরং কলেজে সমবয়স্ক বন্ধু নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়কে পেয়ে সাহিত্যচর্চা চলল আরও জোর গতিতে। বের করলেন হাতে লেখা পত্রিকা-‘জয়ঢাক’। এত কিছুর মধ্যেও আইএ তে প্রথম বিভাগ পেলেন পরবর্তীতে মধ্যবিত্ত সমাজের ভাঙনের নিপুণ কথাকার নরেন্দ্রনাথ মিত্র।

এ বার শান্তিনিকেতন। সময় গত শতকের পঞ্চাশের গোড়া। এখানে ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্রটি আর কেউ নন, স্বয়ং অমর্ত্য সেন। তাঁর ইন্টারমিডিয়েটের শুরুর দিনটির কথা লিখে গিয়েছেন হীরেন্দ্রনাথ দত্ত। দিনটা ছিল বুধবার। শান্তিনিকেতনের ছুটির দিন। তখনও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেই শান্তিনিকেতনের ছাত্রদের পরীক্ষা দিতে হত। কাজেই ছুটির দিনে পরীক্ষা শুরু হলেও কিছু করার নেই। ছুটির দিনে আবার শান্তিনিকেতনে অনেক সভা-সমিতি হয়।

সে দিনও চলছে। ‘সাহিত্যিকা’র বার্ষিক সভা। প্রধান বক্তা অমর্ত্য সেন। সম্বৎসরের কাজের নানা ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়ে অমর্ত্য সেন বক্তব্য রাখছেন রীতিমতো তথ্য দিয়ে। বক্তব্য শেষ হল। ‘সাহিত্যিকা’র সভাপতি অমর্ত্য সেনের কিছু অভিযোগ মেনে নিয়েও আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করলেন। বেশ উত্তেজনাপূর্ণ সভা। এরই মধ্যে হঠাৎ সিংহসদনে ঘণ্টাধ্বনি হল। অমর্ত্য সেন ও তাঁর এক সহপাঠী সভাপতির অনুমতি নিয়ে চললেন পরীক্ষা দিতে। যে সে পরীক্ষা নয়। ইন্টারমিডিয়েটের মতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। ফলাফল?
বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম।

শিক্ষক, ভগবানগোলা হাইস্কুল

তথ্যঋণ— ‘বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়’/রুশতী সেন, ‘ভাষা ও সাহিত্য’/হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, ‘বুদ্ধদেব বসুর জীবন’/সমীর সেনগুপ্ত’,‘আত্মস্মৃতি’/সজনীকান্ত দা্স, ‘আত্মকথা’/নরেন্দ্রনাথ মিত্র, ‘পশ্চাৎপট(আত্মচরিত)’/বনফুল, ‘জীবনানন্দ’/গোপালচন্দ্র রায়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement