নিদর্শন: শিকার চলছে। নিজস্ব চিত্র
জিম করবেটের সবচেয়ে বড় পরিচয়, তিনি এক শিকারি। আর শিকারের কাহিনি লেখক। সারা জীবন বহু শ্বাপদ তাঁর গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে। অথচ একটা আকর্ষণীয় তথ্য হল, এ দেশের প্রথম ন্যাশনাল পার্ক তাঁর নামেই। বন এবং বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ নিয়ে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের অনেকেরই দাবি, ভারতে সংরক্ষণের বিষয়ে পথ দেখিয়েছিলেন জিম করবেটই। যদিও অন্য একটি তথ্যও মেলে। তাঁর আগে দুই ব্রিটিশ বন আধিকারিক ই আর স্টিভেন্স এবং ই এ স্মাইথস ১৯১৬ এবং ১৯১৭ সালে প্রথম সংরক্ষিত অরণ্যের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের সেই প্রস্তাব ব্রিটিশ অফিসার পারসি উইন্ডহ্যাম খারিজ করে দিয়েছিলেন।
কিছুদিন আগে পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদলে এসেছিলেন ব্রিটিশ লেখক এবং অধ্যাপক জন টিম। তিনি পরিবেশ, বন, বাস্তুতন্ত্র এবং মানুষের সঙ্গে যোগ নিয়ে কাজ করেন। জন ঘুরতে গিয়েছিলেন মহিষাদল রাজবাড়িতে। সেখানে পালকি দেখে তিনি খুশি হন। কিন্তু রাজবাড়িতে স্টাফ করা জীবজন্তু দেখে তাঁর বন বিষণ্ণ হয়ে পড়ে।
দু’টো উদাহরণের সঙ্গে একটা যোগ রয়েছে। ব্রিটিশ আমলে শিকার একই সঙ্গে শৌর্য আর আমোদের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। করবেট সাহেব কোনওদিন আমোদের শিকারে যোগ দেননি। কিন্তু এদেশের জঙ্গলে বুনো জন্তু নিকেশ করার কাজে মেতে ওঠা ব্রিটিশ পুরুষদের সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কথা বুঝিয়েছিলেন এক শিকারিই। যিনি ভারতের গ্রামে-গঞ্জে থাকা মানুষজনকে ভালবাসতেন। আবার এদেশে জমিদারতন্ত্র, রাজতন্ত্রের সময়ে আনন্দের খোরাক হিসেবে শিকার উৎসব হত। বনের ভেতর ফাঁকা জায়গায় তাঁবু ফেলে সকলে জড়ো হতেন। জমিদারের লোকজন যেমন থাকতেন তেমনই দক্ষ শিকারি, স্থানীয় যুবকেরাও থাকতেন। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে নানান শব্দ করে বন্য জন্তুদের ভয় দেখিয়ে এক জায়গায় তাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে শিকার করতেন তাঁরা।
শিকার কখনও লোকাচারও। ফাগুন থেকে জৈষ্ঠ প্রায় চার মাসের নির্দিষ্ট কোনও দিনে, পূজা-পার্বণ বা লোকাচারকে কেন্দ্র করেই এই শিকার উৎসব পালিত হত।
দিন বদলেছে। সেই জমিদারতন্ত্র নেই। রাজতন্ত্রও নেই। নেই বনের সেই আদিম গভীরতা, বন্য জন্তু, বনভূমি এবং বনজ সম্পদ। পুরুলিয়ার একসময়ের গর্ব ছিল ভালুক, গাধা বাঘ, নেকড়ে, হরিণ আর দেখা যায় না। অথচ সতেরো-আঠেরো বছর আগেও বুনো ভালুক অযোধ্যার শিরকাবাদ গ্রামের আখ বাগানে আখ খেতে আসত। বর্তমানে প্রাণীগুলো প্রায় নিশ্চিহ্নের পথে।
জলপাইগুড়ির বৈকুণ্ঠপুর বনাঞ্চলে দেখা মিলত হরিণ, শূকর-সহ নানান বন্য জন্তু এমনকি বাঘও। পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া এবং ঝাড়গ্রাম জেলার বনভূমিতেও প্রায়ই দেখা মিলত হরিণ, গাধা, বাঘ, হায়না, নেকড়ে, বুনো শূকর, বনরুই অর্থাৎ পিপীলিকাভুক, শেয়াল, আরও কত কী। এখন এই প্রাণীদের বেশির ভাগই নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। এখন আর দেখা যায় না। ঠিক একই রকম ভাবে পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র বন্য জন্তু হয় নিজেদের সংকটের সঙ্গে লড়াই করছে না হয় নিশ্চিহ্নের পথে।
এক সময় বনে বন্যজন্তু শিকার বেআইনি ছিল না। বরং উল্টে শিকারিদের বুনো হাতি, বাঘ, নেকড়ে, হরিণ বা এই ধরনের প্রাণী শিকারে শিকারিদের প্রশাসন ব্যবহার করত। তখন বন্য জন্তুদের বেঁচে থাকার জন্য সংরক্ষণের প্রয়োজন হয়নি। কারণ বনে তাদের দেখা মিলত। সংখ্যায় বেশি ছিল। তাদের বেঁচে থাকার, বংশ রক্ষা করার পরিবেশ ছিল উপযুক্ত। কিন্তু বর্তমানে বন্যপ্রাণীদের রক্ষা জরুরি হয়ে পড়েছে।
প্রাণীদের রক্ষার ক্ষেত্রে একটি অসুবিধা, ঐতিহ্য মেনে শিকার। এখনও পড়শি রাজ্য-সহ দূরদূরান্ত থেকে নানান বয়সের কয়েক হাজার মানুষ অযোধ্যা পাহাড়ের দুর্গম জঙ্গলে বুদ্ধ পূর্ণিমার দিনে শিকার উৎসবে মেতে ওঠেন। এখনও নানান উৎসব লোকাচারকে কেন্দ্র করে ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, জলপাইগুড়ি-সহ পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র তির ধনুক, বল্লম, তলোয়ার এমনকি ছোট আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে শিকার উৎসবে যোগ দেন। তাঁরা দলবদ্ধ ভাবে গভীর বনে বুনো জন্তু শিকার করেন। এই হনন উৎসব রুখতে প্রতি বছর বহু সচেতনতার অনুষ্ঠান হয়। শিকার রুখতে বনে টহল দেওয়া হয়। কিন্তু শিকার বন্ধ হয় না। উৎসবের নামে, ঐতিহ্যের নামে চোখের সামনে গভীর বনে শিকারিরা ঢুকে, বুনো জন্তুদের হত্যা করেন তাঁরা। আর অসহায়ের মত বন কর্মচারীরা দেখতে থাকেন। নিচুতলার বন কর্মচারীদের ক্ষুদ্র সামর্থ্য। দক্ষিণবঙ্গের বনাঞ্চলে দলবদ্ধ শিকারিদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা তাঁদের নেই। নেই বন্যপ্রাণ আইনে গ্রেফতার করার ক্ষমতা। তাঁরা কার্যত অসহায়।
তবে বছর কয়েক হল কিছু পরিবর্তন ঘটতে দেখা যাচ্ছে। শিকার উৎসবে শিকারিদের আগমন কমছে। তার কারণ সঠিক ভাবে বলা শক্ত। হতে পারে বুনো জন্তু কমে গিয়েছে জঙ্গলে। তাই শিকারে অনেকের মন লাগছে না। আবার হতে পারে লাগাতার সচেতনতার কারণে বা প্রশাসনিক কারণে শিকার উৎসবে শিকারিদের আনাগোনা ধীরে ধীরে কমেছে। সাফল্য নিয়ে এখনও দাবিদাওয়া শুরু হয়নি। বুনো জন্তু নিজের হাতে শিকার শিকারির কাছে এক অদ্ভুত পরিতৃপ্তি। শিকার করতে গিয়ে খালি হাতে ফিরে আসা আত্মগ্লানির কারণ বলেই শিকারিরা উন্মত্ত থাকেন। তা ছাড়া অনেক সময়েই শিকারে যোগ দেওয়া ব্যক্তিরা স্বাভাবিক থাকেন না।
ফাল্গুন থেকে জৈষ্ঠ প্রায় চার মাস প্রতি বছর বিভিন্ন দিনে শিকার শুরু হবে। নির্দিষ্ট দিনগুলোতে শিকারের দামাম বেজে উঠবে। ছোট বড় নানান বুনো জন্তুদের শিকারির হাতে প্রাণ যাবে। নিচুতলার বন আধিকারিকেরা অনন্যোপায় হয়ে শিকারিদের বোঝাবেন। হাতে পায়ে ধরবেন। আর দিনের শেষে হিসেব কষবেন কত শিকারি এসেছিলেন। আর তাঁদের হাতে কত রকমের কী কী বন্য প্রাণী হত্যা হল। বন্যপ্রাণী হত্যার তাজা খবর হবে। কয়েক দিন চলবে দায় কার, কার গাফিলতি ইত্যাদি প্রশ্ন নিয়ে চাপানউতোর। যাঁরা শিকার করেন না বা বন্যপ্রাণী তথা পরিবেশকে ভালবাসেন তাঁরা কিছুদিন প্রতিবাদ করে তাঁদের ক্ষোভকে ব্যক্ত করবেন। প্রতি বছরের মতো এ বছরেও আবার এ বছরেও নানা পরিকল্পনা হবে। কিন্তু বন্ধ হবে কি শিকার? বাঁচবে কি প্রাণীগুলো! অনেকে দাবি করেন, শিকারের ঐতিহ্য নয়। জঙ্গলে বন্যপ্রাণ কমছে চোরাশিকারের কারণে। সেটা রুখতে না পারার ব্যর্থতার কারণ খোঁজা দরকার।
জিম করবেট, যাঁকে দেহাতি মানুষগুলো কার্পেট সাহেব বলতেন, তিনি শিকার করতেন বটে। কিন্তু সংরক্ষণের মহিমাও বুঝেছিলেন। বন এবং বন্যপ্রাণ, দুয়েরই।
লেখক অবসরপ্রাপ্ত সহকারী বিভাগীয় বন আধিকারিক