আজকাল রাজর্ষি উপন্যাসের সেই দৃশ্যটি মনে পড়ে বার বার। রাজা গোবিন্দমাণিক্য সভাস্থলে ঘোষণা করলেন, ‘‘এ বৎসর হইতে মন্দিরে জীববলি আর হইবে না।’’ স্তম্ভিত শ্রোতাদের তিনি জানালেন যে, বালিকার মূর্তি ধরে দেবী তাঁকে বলে গিয়েছেন, ‘করুণাময়ী জননী হইয়া মা তাঁহার জীবের রক্ত আর দেখিতে পারেন না।’ তীব্র তর্ক তুললেন রঘুপতি, কিন্তু রাজা অটল। পুরোহিতের চরম সওয়াল: ‘‘দেবীর যদি কিছুতে অসন্তোষ হইত, আমিই আগে জানিতে পারিতাম।’’ গোবিন্দমাণিক্যের প্রগাঢ় জবাব: ‘‘হৃদয় যার কঠিন হইয়া গিয়াছে, দেবীর কথা সে শুনিতে পায় না।’’ জানি নিশ্চয়, কথাটি রবীন্দ্রনাথের নিজের।
মাঝে মাঝে মনে হয়, চার পাশে যা ঘটছে, রবীন্দ্রনাথ এই সময় হাজির থাকলে কী ভাবে দেখতেন। সেটা এই কারণে নয় যে তিনি সত্যদ্রষ্টা বা মহামানব গোছের কিছু ছিলেন বলে মনে করি। ও-সব নেহাতই ছেঁদো কথা। কিন্তু ওই যে, দীর্ঘ জীবনের সহস্র অভিঘাতেও মানুষটার হৃদয় কোনও দিন কঠিন হয়ে যায়নি, ওটাই তো মস্ত কথা! সত্যি বলতে কী, তাঁর সব কিছু ছাপিয়ে, কিংবা সব কিছু মিলিয়ে যে ব্যাপারটা এখন সবচেয়ে দামি মনে হয় সেটা হল তাঁর ভালবাসার ক্ষমতা। একেবারে শেষ পর্যন্ত তিনি জগৎ ও জীবনকে দেখেছেন ভালবাসা দিয়ে। তা না হলে ‘আমার সোনার বাংলা’ লেখা যায় না। কত দেশের জাতীয় সঙ্গীত শুনি, বীররসে উদ্বুদ্ধ হই, কখনও বা ভক্তিরসে স্নাত, কিন্তু মানুষ তার নিজের দেশকে ‘তোমায় ভালবাসি’ বলে আশ্চর্য মিষ্টি সুরে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে পারে— ভাবলে এই দগ্ধ দিনেও প্রাণটা জুড়িয়ে যায়।
ভালবাসার, অন্তত রবীন্দ্রনাথ ভালবাসা বলতে যা বুঝতেন, তার প্রধান শর্ত হল এমপ্যাথি— সমমর্মিতা। সেই শর্ত পূর্ণ হলে তবেই তো যাকে ভালবাসি তাকে তার মতো করে বুঝতে পারি, সেই গভীর বোধ নিয়ে তার পাশে দাঁড়াতে পারি, তার বেদনায় বেদনার্ত হয়ে বলতে পারি, ‘মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, আমি নয়নজলে ভাসি।’ তা যদি না হয়, তবে ভালবাসা শব্দমাত্র, তার খোলসের আড়ালে যা পড়ে থাকে সেটা নিছক অধিকার ফলানোর তাড়না। দখলদারি।
দেশপ্রেম মানে দেশকে ভালবাসা। সে অতি কঠিন কাজ। রবীন্দ্রনাথ তা জানতেন। আধিপত্যের নেশায় উন্মত্ত পরুষ জাতীয়তাবাদ যখন দেশপ্রেমের ভেক ধরে দুনিয়া জুড়ে তাণ্ডব চালাচ্ছে, তখনও তিনি নিজস্ব বিবাদী স্বরে অবিচল থেকেছেন। আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে একলা পথ চলার মন্ত্র তাঁকে নিজের জীবনে নিরন্তর অনুশীলন করতে হয়েছে। মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানোকে যিনি পাপ বলে মনে করেন, শেষ দিন অবধি তাঁর হয়তো এই ভরসা ছিল যে, স্বাধীন ভারত আধিপত্যের তাড়নাকে অস্বীকার করে সমমর্মিতার পথে দেশপ্রেমের অর্থ খুঁজবে, তার অনুশীলন করবে।
সেই প্রত্যাশা মেটেনি। নরেন্দ্র মোদীর ভারতে দাঁড়িয়ে জওহরলাল নেহরুর ভারতকে সহিষ্ণু গণতন্ত্রের স্বর্গ মনে হওয়া অত্যন্ত সঙ্গত, কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকেই ভারতীয় রাষ্ট্র যে পথ অনুসরণ করে, তাকে ভালবাসার পথ বললে তঞ্চকতা হবে। সেই রাষ্ট্র গোড়া থেকেই তার উন্নয়নের তকমা আঁটা রথের চাকায় বহু মানুষকে ধারাবাহিক ভাবে পিষে দিয়েছে, বিশেষ করে অগণন প্রান্তিক, আদিবাসী মানুষকে তাঁদের জগৎ ও জীবন থেকে উৎখাত করেছে এবং তাঁদের কৃতার্থ করতে জানিয়েছে: দেশের কল্যাণেই তোমাদের এই আত্মত্যাগ। ছাগশিশুকে হাড়িকাঠে চড়ানোর আগে রঘুপতিও বোধ করি তার উদ্দেশে মনে মনে এমনই বলতেন। নেহরুর অন্তরে হয়তো শেষ অবধি জয়সিংহের বেদনা নিহিত ছিল, কিন্তু ব্যক্তির সঙ্গে রাষ্ট্রকে গুলিয়ে ফেললে চলে না।
আধিপত্যকামী রাষ্ট্রকে চেনা সহজ, আধুনিক ধনতন্ত্রের আধিপত্যকামী পুঁজিকে চেনা তুলনায় কঠিন। সে কাজ করে আমাদের চিন্তায় ও চেতনায় ব্যক্তিস্বাধীনতার মোহ-আবরণ পরিয়ে। কিন্তু নব্বইয়ের দশক থেকে সজাগ ভারতবাসী দেখেছে, ‘উদার অর্থনীতি’ কী ভাবে মানুষের জীবনকে সব দিক থেকে গ্রাস করে, তার সামাজিক সম্পর্ক ও সমবায়গুলিকে ধ্বংস করে বলবৎ করে চলে আদিগন্ত বাজারের শাসন। প্রায় চার দশক আগে মার্গারেট থ্যাচারের উচ্চারণ শুনেছিলাম আমরা: সমাজ বলে কিছু নেই, কেবল ব্যক্তি আছে; যাকে সমাজ বলে ডাকি সে আসলে বিচ্ছিন্ন নাগরিকের সমষ্টি। আজ আর সেই বাণী আমাদের কানে ভয়ঙ্কর শোনায় না, কারণ আমরা তেমন সমাজহীন সমাজেই বেঁচে থাকি, আমাদের নতুন প্রজন্ম সেখানেই জন্মায়, ওই বিচ্ছিন্ন অস্তিত্বই তার কাছে স্বাভাবিক। এমন মানবজমিনে সমমর্মিতা উচ্চফলনশীল হতে পারে না। হয়ওনি— অর্থনীতির প্রচলিত কেতাবে যে স্বার্থসর্বস্ব ‘ইকনমিক ম্যান’-এর কথা লেখা থাকে, সেই প্রজাতির অনুপাত ও গুরুত্ব দ্রুত বেড়ে চলেছে।
পুঁজির পক্ষে এই থ্যাচারতন্ত্র অতীব উপকারী। সামাজিক সংহতি যত দুর্বল, সমাজের মানুষ যত বিচ্ছিন্ন, পুঁজির দিগ্বিজয় তত সহজ। এটা মোটেই কাকতালীয় নয় যে, তার অশ্বমেধের ঘোড়া এখন সবচেয়ে বেশি বাধা পাচ্ছে জনজাতীয় বা আদিবাসী সমাজের কাছে, সেটা প্রেসিডেন্ট এভো মোরালেস-এর বলিভিয়াতেই হোক অথবা ওড়িশার নিয়মগিরিতেই হোক। এই প্রতিরোধ নিয়ে অতিরিক্ত আশাবাদের কোনও স্থান নেই। সামাজিক সংহতির নিরন্তর প্রসার ঘটিয়ে প্রতিরোধকে রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ দিতে না পারলে সর্বগ্রাসী পুঁজি তাকে ভাঙবেই, বিশেষত রাষ্ট্র যখন তার পরম সহায়। এক কালে প্রতিরোধী সংহতি নির্মাণে বামপন্থী দল ও সংগঠনগুলি নেতৃত্ব দিয়েছিল, আজ তাদেরও হাল ভাঙা, পাল ছেঁড়া। শ্রমজীবী মানুষের সামাজিক সংহতি ধ্বংস হওয়ার ফল কী হয়, সেটা এখন চতুর্দিকে দৃশ্যমান— নানা ক্ষেত্রে হাজার হাজার কর্মী প্রতিনিয়ত জীবিকা হারাচ্ছেন, কিন্তু সেই বিপর্যয় কিছু সংখ্যা হয়েই থেকে যাচ্ছে। বিচ্ছিন্ন সংখ্যা, যত বড়ই হোক, সংহতি দেয় না, প্রতিরোধ গড়ে না। নিয়োলিবারাল অর্থনীতি এই বিচ্ছিন্নতা উৎপাদন করে চলেছে এবং তার ফসল তুলে চলেছে।
যে বিচ্ছিন্নতা পুঁজির সহায়, সেই বিচ্ছিন্নতাই সংখ্যাগুরুবাদী অতিজাতীয়তার সমিধ। সামাজিক সংহতি দুর্বল, সমাজের মানুষেরা বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিতে পরিণত, তার ফলে সুগম হয়েছে ধর্মীয় পরিচয় ও জাতীয় নিরাপত্তার যৌথ প্রকরণ ব্যবহার করে সংখ্যাগুরুর মহাজোট নির্মাণের পথ। এ পথ নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তারের। সেই দখলদারি প্রতিরোধ মানতে নারাজ, প্রশ্ন শুনতে নারাজ। তার লক্ষ্য: আনুগত্য যার নেই, তাকে তাঁবে আনতে হবে। যে ভাবে হোক।
আর তাই, কাশ্মীরে যা হয়েছে এবং হচ্ছে, তার অনৈতিকতা ও অমানবিকতা যত বিকট এবং যত নিরাবরণই হোক, তাতে রাষ্ট্রের কিছু যায় আসে না। যে সমাজ এই রাষ্ট্রকে ধারণ করে, তারও কিছু যায় আসে কি? অমিত শাহের ঘোষণা, যত আকস্মিকই শোনাক, আকাশ থেকে তো পড়েনি! অনেক দশক ধরে, বিশেষ করে ইন্দিরা গাঁধীর রাজত্ব থেকে, কাশ্মীরে দিল্লীশ্বরদের আধিপত্য বিস্তারের যে উৎকট অভিযান চলে এসেছে, ভারতীয় সমাজের এক বিরাট অংশ, সম্ভবত অধিকাংশই তাতে কিছুমাত্র বিচলিত হয়নি। তার কারণ, কাশ্মীরের মানুষকে তারা কোনও দিনই আপন বলে মনে করেনি। মোদী সরকারের চালকদের মস্ত কৃতিত্ব, তাঁরা এই বাস্তবকে ঠিক ঠিক পড়ে নিয়েছেন। তাঁরা নির্বোধ নন, খুব ভালই জানেন, তাঁদের সিদ্ধান্ত কতখানি ভয়ানক, গণতন্ত্রের পথ থেকে কতটা দূরে। কিন্তু, বুদ্ধিমান বলেই, তাঁরা এটাও জানেন যে, সমাজের বিরাট অংশের মন— সংখ্যাগুরু মন— তার জন্য তৈরি ছিল।
তার যথেষ্ট পরিচয় গত এক সপ্তাহ ধরে পাওয়া গিয়েছে। রাষ্ট্রীয় ঘেরাটোপের ফাঁকফোকর দিয়ে কাশ্মীরি মানুষের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার যে সব কাহিনি আমরা জেনেছি, মানুষ নামধারী যে কোনও প্রাণীর মনে তার তীব্র অভিঘাত হওয়ার কথা। সেটাই দেশ, জাতি, ধর্ম, দলমত, সব কিছুর বাইরে নিছক মানবিকতার শর্ত। অথচ— রাষ্ট্রযন্ত্রী এবং তাঁদের কর্মী-ভক্ত-প্রচারক বাহিনীর কথা ধর্তব্য নয়— চার পাশের বহু আপাত-স্বাভাবিক মানুষও এই কাহিনিগুলি জেনে বড়জোর একটু আহা-উহু করেই বলতে শুরু করছেন, ‘কিন্তু এটার তো দরকার ছিল, ওদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা কেন থাকবে?’ একটু ফোন করার সুযোগ পেয়ে জননী দূরে থাকা সন্তানকে বলছেন, ‘এ বার ইদে বাড়ি আসিস না’— এমন কাহিনি শুনেও ওই আপাত-স্বাভাবিক মানুষেরা যন্ত্রের মতো প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছেন, ‘কাশ্মীরি পণ্ডিতরা যখন ছিন্নমূল হন, তখন আপনারা চুপ করে ছিলেন কেন?’ এই সব সওয়ালে আর যা-ই থাকুক, সমমর্মিতার কোনও স্থান নেই। (পণ্ডিতদের প্রতিও নয়, তাঁরা প্রচারের উপকরণমাত্র।) ঠিক যেমন সমমর্মিতার স্থান নেই ‘কাশ্মীর এ বার উন্নতির পথে এগিয়ে চলবে’ মার্কা সরকারি ঘোষণায়। এ-সবই কথার কথা। লক্ষ্য একটাই: কাশ্মীর আর তার মানুষদের দখল নিতে হবে। তাঁদের মনের কথা শোনার, তাঁদের চিন্তা ও চেতনার শরিক হওয়ার প্রশ্নই উঠছে না। ভালবাসা শব্দটাই এখানে অবান্তর।
সমাজের হৃদয় কঠিন হইয়া গিয়াছে।