ব ৎসরে কতগুলি দিন থাকিবে, কিংবা কতটা দূরত্ব এক কিলোমিটার বলিয়া গণ্য হইবে, সরকার তাহা স্থির করিতে পারে না। কতটা আর্সেনিক থাকিলে জল ‘দূষিত’ হয়, তাহাও সরকারি সিদ্ধান্তের বিষয় নহে। অথচ পশ্চিমবঙ্গ সরকার আর্সেনিক দূষণের পরিমাপ লইয়া শিশুসুলভ গোঁ ধরিয়াছে। ভূগর্ভস্থ জলের প্রতি লিটারে পঞ্চাশ মাইক্রোগ্রামের নীচে সে নামিতে রাজি নহে। কেন্দ্রীয় সরকার অবশ্য সংসদীয় কমিটির নির্দেশে আর্সেনিক দূষণের আন্তর্জাতিক পরিমাপ, লিটারে দশ মাইক্রোগ্রাম, গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছে। তাহাতে পশ্চিমবঙ্গে আর্সেনিক-দূষিত ব্লকের সংখ্যা তিরাশি হইতে দাঁড়াইয়াছে এক শত ত্রিশ। জলে দূষণমুক্তির দায়িত্ববাহী জনস্বাস্থ্য কারিগরি দপ্তরের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় অবিশ্বাসের সুরে বলিয়াছেন, এত বেশি হইতেই পারে না। কেন? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ্যা বিভাগ দশ বৎসর পূর্বে যে মানচিত্র দিয়াছিল, তাহাতে এক শত এগারোটি ব্লক ‘দূষিত’, তাহাও সাবেক মাপে। ওই প্রতিষ্ঠানের সমীক্ষা অনুসারে, আশির দশকের বাইশটি গ্রাম হইতে ২০০৬ সালে তিন হাজারেরও অধিক গ্রামে দূষণ ছড়াইয়াছে। অতএব নূতন সংখ্যা অসংগত নহে। স্বাস্থ্য ও প্রাণের সুরক্ষার প্রশ্নে দূষণের মাপ লইয়া দরাদরিই অসংগত।
একটি রিপোর্টে প্রকাশ, পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম ও শহরের আর্সেনিক-দূষিত অঞ্চলে প্রায় তিন কোটি মানুষের বাস। রাজ্যে এক কোটিরও অধিক মানুষ আর্সেনিকের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত, সেই তথ্য লোকসভায় পেশ করিয়াছে কেন্দ্রের পানীয় জল ও নিকাশি মন্ত্রক। এ বিষয়ে এ রাজ্য ভারতে শীর্ষে। যে সব ব্যক্তির শরীরে বিষক্রিয়া শুরু হইয়াছে কিন্তু এখনও চিহ্ন দেখা যায় নাই, বা চিকিৎসকের নজরে আসে নাই, তাহাদের সংখ্যাও কম হইবে না। আর্সেনিক দূষণ দীর্ঘকালই এক জনস্বাস্থ্য সংকট, নূতন পরিমাপের প্রয়োগে তাহার ব্যাপকতা আরও স্পষ্ট। ইহাও সম্পূর্ণ চিত্র না হইতে পারে। সরকার আক্রান্ত ব্লকের সংখ্যা কেন তিরাশিতে বাঁধিতে চাহে, সে প্রশ্নটিও প্রাসঙ্গিক। খাদ্য সুরক্ষায় যে রাজ্য প্রতি বৎসর সাত শত কোটি টাকার অধিক রাজস্ব ব্যয় করিতেছে, পানীয় জলের সুরক্ষার জন্য সে কেন্দ্রের বরাদ্দও খরচ করিয়া উঠিতে পারে নাই— এই সত্যটি অস্বস্তিকর বলিয়াই কি?
রাজ্যের কর্তারা যথারীতি আঙুল তুলিয়াছেন কেন্দ্রের কার্পণ্যের দিকে। দ্বাদশ পরিকল্পনায় অবশ্য জাতীয় গ্রামীণ পানীয় জল প্রকল্পের অধীনে পশ্চিমবঙ্গের জন্য চৌদ্দশো কোটি টাকা বরাদ্দ হইয়াছিল। আর্সেনিক ও ফ্লোরাইড কবলিত এলাকার জল সরবরাহ প্রকল্পের জন্য নির্দিষ্ট ওই টাকার কত আসিয়াছে, কত খরচ হইয়াছে? আর্সেনিক-মুক্তির কী পরিকল্পনা রাজ্য করিতেছে, তাহাও স্পষ্ট নহে। আশি-নব্বইয়ের দশকে নলকূপগুলির মুখে ‘ফিলটার’ লাগাইবার কাজ শুরু হইয়াছিল। তাহাতে জল শুদ্ধ হইলেও ব্যয়বাহুল্য ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কার্যকর হইতে পারে নাই। অতঃপর পুকুর-নদীর জল শোধন করিয়া ছোট ছোট প্রকল্পের মাধ্যমে সীমিত এলাকায় সরবরাহ, এবং শেষ অবধি পাইপের জল সরবরাহের বৃহৎ প্রকল্প, এমন নানা পরিকল্পনা লইয়াছে সরকার। ইহার কোনটা কতখানি ফল দিয়াছে? তিন কোটি মানুষের কত জন এখন সুপেয় জল পাইতেছেন? সংকটকে লঘু না করিয়া রাজ্য সরকার স্পষ্ট উত্তর দিবে, ইহাই প্রত্যাশা।