আমরা কি গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে পারছি?

নিবার্চনী পরবর্তী সংস্কারে শাসক কবে অসাধু কাজ থেকে আমাদের বিরত করে এক নতুন গণতন্ত্রের মন্দির, মসজিদ, গির্জা নির্মাণ করাবে? লিখছেন স্বদেশ রায়চারদিকে একটা গেল গেল রব উঠেছে। এ তো গণতন্ত্রের উপর আক্রমণ। অসাধু পথ অবলম্বন করে ভোটে জেতা প্রহসনে পরিণত হয়েছে। এ ভাবে নির্বাচন পরিচালনা করলে মানুষ তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০১৯ ০২:১০
Share:

রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। যুদ্ধ ও রাজনীতি কোনও নিয়ম মেনে চলে না। রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা, শিষ্টাচার, নীতিবোধের উপর দাঁড়িয়ে কোনও দিনই রাজনীতি বা নির্বাচন সম্পন্ন হয়নি। তবে সেকাল ও এ কালে অনেক ব্যতিক্রমী ঘটনার সাক্ষী আমরা। এখন ভোট মানেই গায়ের জোর, অর্থ, পেশিশক্তির প্রদর্শন, অনিয়ম ও বেনিয়ম। সাধারণ নিবার্চকমণ্ডলী অসহায়। গণতন্ত্র ধ্বংসের মুখে। গণতন্ত্র রক্ষার দায়িত্ব আমার-আপনার সকলের। মানুষের চিত্তশুদ্ধি ‘গণতন্ত্র’কে রক্ষা করার প্রধান পথ। এই অসময়ে আমরা প্রকৃতই কি গণতন্ত্র রক্ষার তাগিদ দেখাতে পেরেছি? মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নিলে ভোট ও ভোটারের মূল্য কোথায়?

Advertisement

চারদিকে একটা গেল গেল রব উঠেছে। এ তো গণতন্ত্রের উপর আক্রমণ। অসাধু পথ অবলম্বন করে ভোটে জেতা প্রহসনে পরিণত হয়েছে। এ ভাবে নির্বাচন পরিচালনা করলে মানুষ তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। আমরা রাজনীতি সচেতন বলে গর্ব অনুভব করি। কিন্তু আমরা সত্যি কতটুকু সচেতন, তার একটা সমীক্ষারও প্রয়োজন আছে। এখন যা ঘটছে, সেটা দু-পাঁচ বছরের বিষয় নয়। আমাদের অতীত সম্বন্ধে বিচার বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে।

রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা, শিষ্টাচার, ব্যক্তি আক্রমণ, কুৎসা সবই ভোটেরই অঙ্গ। ভোটের হিংসা থেকে পেশিশক্তির প্রদর্শন ও টাকার খেলা নতুন নয়। এ ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। অতীতের ঘটনাবলি একটু স্মরণ করতে পারলে নতুন বলে মনে হবে না। রাজনীতিতে ব্যক্তি আক্রমণ আগেও ছিল, এখনও আছে। এ আক্রমণ কখনও মনস্তাত্বিক কখনও ভাষাগত। পঞ্চাশের দশক থেকে ষাটের দশকে এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ কংগ্রেস নেতা অতুল্য ঘোষকে ‘কানা অতুল্য’ বলে সম্বোধন করা হত। কিন্তু অতুল্য ঘোষের কানা হয়ে যাওয়ার পিছনে যে কারণটি ছিল, তা আজও অনেকের কাছেই অজানা। স্বাধীনতা আন্দোলনে কারাবাসের সময় জেলরক্ষীর আক্রমণে তাঁর চোখটি নষ্ট হয়ে যায়। সেই কারণটি গৌণ হয়ে ‘কানা অতুল্য’ মুখ্য হয়ে ব্যক্তি আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। প্রফুল্ল সেন কোনও সময় কাঁচকলা খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাই তাঁকেও কাঁচকলার বিদ্রুপ শুনতে হয়েছে। অতুল্য ঘোষকে কানা বেগুন, প্রফুল্ল সেনকে কাঁচকলা বলা হত। কানা বেগুন ও কাঁচকলার ঘণ্ট একটি উপাদেয় পদ বলে চালানো হত রাজনৈতিক মঞ্চে। ছড়া বাঁধা হয় ‘জলের শত্রু কচুরিপানা, দেশের শত্রু অতুল্যকানা’।

Advertisement

আবার বলা হত ‘দেহের শত্রু পাঁচড়া খোস, বাংলার শত্রু জ্যোতি বোস। তবুও তাঁরা শ্রদ্ধেয়। ইন্দিরা গাঁধী থেকে জ্যোতি বসু, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রত্যেকেই ব্যক্তি আক্রমণের শিকার। এই আক্রমণে অশালীন শব্দ কম প্রয়োগ হয়নি।

ভোটে কারচুপির কত ঘটনাই শুনি। এই বাংলায় এমনই কারচুপি ঘটেছিল শাসক ও বিরোধী দলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। ১৯৫৭ সালে কলকাতার বৌবাজার কেন্দ্রে বিধানচন্দ্র রায় হারতে বসেছিলেন। তখন নির্বাচনে এখনকার মতো একটি ব্যালটবক্স ব্যবহার করা হত না। প্রতিটি দলের আলাদা আলাদা ব্যালটবক্স থাকত প্রতীক চিহ্ন-সহ। জোড়া বলদের বাক্স, কাস্তে ধানের শীষ বাক্স, চালাঘর ইত্যাদি। যার বাক্স থেকে অধিক পরিমাণে ব্যালটপেপার পাওয়া যেত, তিনিই বিজয়ী হতেন। মহম্মদ ইলিয়াসের বাক্সের কাগজ জোড়া বলদের বাক্সে ‘সাপ্লাই’ করে বিধান রায়কে জেতানো হয়েছিল। সৌজন্যে অবশ্যই জ্যোতি বসু। এখন এই হৃদ্যতা বিরল।

এ রাজ্যে বুথ দখল, ছাপ্পা ভোট, বহুতল বাড়ির গেটে তালা লাগিয়ে ভোটদাতাদের ভোটদানে বঞ্চিত করার উদাহরণ রয়েছে। তবে ভোটে রিগিং করার ক্ষেত্রে একটা বিষয় লক্ষ করা যায়। যারা রিগিং বা বুথ দখল করে, তাদের পিছনেও একটা জনসমর্থন থাকে। জনসমর্থন ছাড়া শুধু রিগিং করে ভোটে জেতা যায় না।

যেমন, ১৯৭৭ সালে ডায়মন্ডহারবার কেন্দ্রে কংগ্রেস রিগিং করার চেষ্টা করেও সফল হয়নি। প্রয়াত জ্যোতির্ময় বসুর দলের কাছে মার খেয়ে পিছিয়ে আসতে হয়েছিল ছাত্রনেতা বীরেন মহান্তিকে। আসলে ‘জোর যার মুলুক তার’ এর পিছনেও জনশক্তি কাজ করে। যেখানে জনসমর্থন সমান সমান, সেখানেই সংঘর্ষ। প্রতিপক্ষ দলের কর্মীদের বুথে বসতে না দেওয়া, এজেন্টকে মেরে তাড়িয়ে দেওয়া— এ সব আজকের ঘটনা নয়। ১৯৬৯ সালে প্রাক্তন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ভি কে কৃষ্ণমেনন পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর কেন্দ্রে উপনিবার্চনে সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রার্থী হয়ে জিতেছিলেন ১,০৬,৭৬৭ ভোটে। সে ভোটে বেলা ১২টার আগেই কংগ্রেসের ক্যাম্প অফিস ভেঙে দেওয়া, পোলিং এজেন্টকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই ঘটনা আজও চলছে।

আবার আদর্শের জন্য লড়াই, রাজনৈতিক শিষ্টাচারের অন্য একটি নমুনা দেওয়া যেতে পারে। বহরমপুর গার্লস কলেজের অধ্যাপক রেজাউল করিম প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি এবং পশ্চিমবঙ্গ বিধান পরিষদের সদস্য ছিলেন। শিক্ষাবিদ রেজাউল করিম রাজনীতি পরিহার করেননি কিন্তু রাজনীতি তাঁর নিছক পেশা ছিল না। ছিল সমাজ রূপান্তরের ব্রত, জীবনবোধের ব্রত। ১৯৭১ সালে লোকসভা নিবার্চনে জাতীয় কংগ্রেসের প্রার্থী হয়েও খোলা মনে ভাষণে বলতে পেরেছিলেন ‘যোগ্যতা যদি বিচার্য বিষয় হয় তবে ত্রিদিব চৌধুরীকে ভোট দেবেন, যদি জাতীয় কংগ্রেসের মতাদর্শে বিশ্বাসী হন তা হলে আমাকে ভোট দেবেন।’ নির্বাচনে তিনি পরাজিত হলেও তিনিই প্রকৃত বিজয়ী। তাঁর নিবার্চনী ভাষণে ও আচরণে মহত্তম গণতান্ত্রিক আদর্শের গৌরব সুব্যক্ত হয়েছে। এমন উদাহরণ আর কি ফিরে আসবে?

একবিংশ শতাব্দীতে নয় নয় করে লোকসভা ও বিধানসভার সাতটা ভোট অতিক্রম করতে চলেছি। এখন সারা বছর ধরেই কোনও না কোনও নির্বাচনের ঘণ্টা বেজেই চলেছে। অতীতে বারোয়ারি পুজোর মতো কয়েকটা মিটিং করেই নির্বাচনী ময়দানে নামা হত। এখন সারা বছরই নির্বাচনী কার্যকলাপ লেগেই থাকে। পঞ্চায়েত, পুরসভা থেকে লোকসভা, বিধানসভা নির্বাচনে টাকার উৎসগুলি দখল করার একটা প্রচেষ্টা লেগেই থাকে। বছরভর এলাকা দখল, সংগঠন বাড়ানোর কৌশল থামে না।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ড. অম্লান দত্তের উদ্ধৃতি থেকে বোঝা যায় কেন এত হিংসা, হানাহানি। ‘অন্তর্ঘাতী হিংসায় মানুষ অন্য বহু জীবকেই ছাড়িয়ে যায়। কোলকাতার যেখানে আমার বাস, সেখানে মানুষে মানুষে খুনোখুনি লেগেই আছে। আমাদের বাড়ির পিছনে ধানখেত। রাতে শেয়ালের ডাক শোনা যায়। পাড়ার কুকুরের সঙ্গে শেয়ালের মাঝে মাঝে লড়াই লাগে। এক-আধটা শেয়াল কখনও কখনও মারা যায়। কিন্তু কোনও কুকুর অন্য কুকুরকে খুন করেছে এমন চোখে পড়েনি। মানুষ যদি পারস্পরিক হিংসায় কুকুরের স্তরে উন্নত হতে পারত তা হলে আমাদের অঞ্চলে শান্তি বৃদ্ধি পেত।’

গণতন্ত্রের উৎসবে বলিদান প্রথা কবে নির্বাসন নেবে সে দিকে আমাদের চেয়ে থাকতে হবে। ধর্মীয় বলিদান প্রথার অবলুপ্তি ঘটেছে। কিন্তু মানুষ কবে বিরত হবে? নির্বাচনী পরবর্তী সংস্কারে শাসক কবে অসাধু কাজ থেকে আমাদের বিরত করে এক নতুন গণতন্ত্রের মন্দির, মসজিদ, গির্জা নির্মাণ করাবে? একটি আশা ও আতঙ্কের দিন আমাদের আর কত দিন বইতে হবে? পুরাতন হিংসাকে যেন আর নতুন ভাষায় প্রকাশ না করি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement