আমরা কি পরস্পরকে শ্রদ্ধা করতে ভুলে যাচ্ছি?

আপন স্বার্থ চরিতার্থ করতে প্রতিপক্ষকে ছুড়ে ফেলছি। কুৎসিত কদর্যতায় কালিমালিপ্ত করছি অন্যদের। এতে সংসার, সমাজ-সংস্কৃতি সবই যাচ্ছে রসাতলে। লিখছেন সুদীপ্তকুমার চক্রবর্তীআবার এপিজে আবদুল কালাম ‘উইংস অব ফায়ার’ গ্রন্থে তাঁর ছেলেবেলার যে চিত্র আঁকছেন সেখানে দেখছি, কালামের পিতা জয়নাল  আবদিনের অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু হচ্ছেন রামেশ্বর শিব মন্দিরের প্রধান পুরোহিত পক্ষি লক্ষ্মণ শাস্ত্রী।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০১৯ ০১:৪৬
Share:

আকিরা কুরোসাওয়া ও সত্যজিৎ রায়

জাপানি চলচ্চিত্রকার আকিরা কুরোসাওয়া ও সত্যজিৎ রায় ছিলেন সমসাময়িক। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পরিচালকদের মধ্যে তাঁরা অন্যতম ও অগ্রগণ্য। দু’জনে দু’জনের কাজ সম্পর্কে ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল যেখানে ঈর্ষা তিলমাত্র স্থান করে নিতে পারেনি। কুরোসাওয়াকে বিশ্ব চলচ্চিত্রের অন্যতম একজন পথিকৃৎ বলে সর্বদা স্বীকার করতেন সত্যজিৎ রায়। আবার সত্যজিৎকে নিয়ে আকিরা কুরোসাওয়ার মন্তব্যটি সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘‘চলচ্চিত্রে মানবজাতির যে অভিনব উপস্থাপন সত্যজিৎ দেখিয়েছেন তা এককথায় অনবদ্য। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তিনি এক জন বড় মাপের মানুষ। তাঁর ছবি না দেখার অর্থ হল পৃথিবীতে বাস করেও চাঁদ কিংবা সূর্যের উপস্থিতি সম্পর্কে অবহিত না থাকা।’’ কী অসাধারণ পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ!

Advertisement

আবার এপিজে আবদুল কালাম ‘উইংস অব ফায়ার’ গ্রন্থে তাঁর ছেলেবেলার যে চিত্র আঁকছেন সেখানে দেখছি, কালামের পিতা জয়নাল আবদিনের অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু হচ্ছেন রামেশ্বর শিব মন্দিরের প্রধান পুরোহিত পক্ষি লক্ষ্মণ শাস্ত্রী। এক জন ধর্মপ্রাণ মুসলমান, অন্য জন বিশিষ্ট হিন্দু। অথচ ধর্মের এই বিভিন্নতা তাঁদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধে এতটুকু ঘাটতি ঘটায়নি। তাঁরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা একসঙ্গে শাস্ত্র আলোচনা করতেন। সেখানে বিদ্বেষ, মালিন্য ও ক্ষুদ্র মানসিকতার কোনও স্থানই ছিল না। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অনুকরণযোগ্য অসাধারণ একটি উদাহরণ ।

এ বার চলে আসি রাজনীতির অঙ্গনে। স্বাধীনতা সংগ্রামী ত্রিদিব চৌধুরী বহরমপুরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক সন্তানের নাম। গোয়া আন্দোলনের পুরোধা, তিনি ছিলেন আরএসপি পার্টির অন্যতম এক জন প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৫২ সাল থেকে দীর্ঘ দিন বহরমপুরের সাংসদ ছিলেন তিনি। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৫৭ সালে জওহরলাল নেহরু তাঁর বিরুদ্ধে কংগ্রেসকে প্রার্থী দিতে দেননি। আবার উদারতা, বিদ্যাবত্তা ও অসাম্প্রদায়িকতার মূর্ত বিগ্রহ রেজাউল করিম সাহেব ছিলেন বহরমপুরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক কীর্তিমান সন্তান। সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির মিলনের অন্যতম রূপকার হিসেবে ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত তাঁর নাম। সেই সময় তিনি ছিলেন প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি। তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ছিল আপামর বহরমপুরবাসীর ও অবশ্যই ত্রিদিব চৌধুরীর। তাঁর প্রতি রেজাউল করিম সাহেবের মনোভাব কেমন ছিল তা একটু জানা যাক।

Advertisement

১৯৭১ সালের লোকসভা নির্বাচনে ওঁরা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। দু’জনের পক্ষেই প্রচার চলছে জমিয়ে। রেজাউল করিম সাহেব ত্রিদিব চৌধুরীকে ডাকতেন ঢাকু নামে। ঢাকায় জন্ম বলে এমন নাম। এক দিন মঞ্চে প্রচার করার সময় করিম সাহেব বললেন, ‘‘ঢাকু খুব ভাল ছেলে। আপনারা আমাকেও ভোট দিতে পারেন। আবার ওকেও ভোট দিতে পারেন। ও জিতলেও লোকসভায় অনেক ভাল ভাল কাজ করতে পারবে।’’ বলা বাহুল্য, রেজাউল করিম সাহেব নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিলেন। কিন্তু পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের যে অতুলনীয় গাথা তিনি রচনা করলেন, ইতিহাসে তার তুলনা মেলা ভার।

এ বার চলুন সঙ্গীতের জগতে। সঙ্গীতশিল্পীরা নাকি খ্যাতির অত্যুজ্জ্বল আলোয় অন্ধ হয়ে পরস্পরকে ঈর্ষার চোখে দেখেন। কিন্তু ইতিহাস তো অন্য কথা বলে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের কিংবদন্তী শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাসকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন আর এক কিংবদন্তী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। রবীন্দ্রসঙ্গীতে পারদ পারদর্শিতার ক্ষেত্রে অতুলনীয় উচ্চতায় অবস্থান করা সত্ত্বেও জীবদ্দশায় দেবব্রত বিশ্বাস তেমন সম্মান ও স্বীকৃতি পাননি। তাঁকে সম্মান জ্ঞাপন করার জন্য এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন দেবব্রত অনুরাগী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সেই সভায় দেবব্রত বিশ্বাস সম্পর্কে হেমন্ত তাঁর গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ করে বলেন, রবীন্দ্রসঙ্গীতে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

তার পরে সম্মাননা জ্ঞাপনের পালা শেষ হলে দেবব্রত বিশ্বাস বললেন, ‘‘রবীন্দ্রসঙ্গীতের জন্য আমি তেমন কিছুই করতে পারিনি। রবীন্দ্রসঙ্গীতকে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে হেমন্তের অবদান আমার চাইতে অনেক বেশি।’’ শ্রোতৃকুল হিমালয় সদৃশ্য দুই ব্যক্তিত্বের হিমালয়ের মতোই মহানুভবতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ দেখে শ্রদ্ধায় আনত হন।

অহংয়ের প্রাচীর গুঁড়িয়ে দিয়ে পরস্পরকে শ্রদ্ধার মাধ্যমে একটি আদর্শ স্থাপন করা তাঁদের পক্ষেই সম্ভব যাঁরা কোনও ক্ষুদ্র সীমার মধ্যে নিজেদের আটকে রাখেন না। অথচ যে দিকে তাকাই, এই পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের একান্ত অভাব মনটাকে ভারী করে তোলে। শিক্ষা, চিকিৎসা, রাজনীতি, মন্দির, মসজিদ, গির্জায়, গৃহের নিভৃত ছায়ায়, স্বামী-স্ত্রী এবং অন্য সকল সদস্যের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থেকেই উঠে আসে পরস্পরকে মর্যাদা দেওয়ার শিক্ষা। আর সেখান থেকেই জীবনকে প্রকৃত ভাবে যাপন করার পথ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।

অথচ সমকালের দিকে চেয়ে দেখি এই পারস্পরিক শ্রদ্ধার বিষয়টি আমরা ভুলে যাচ্ছি। নিজেকে জাহির করার জন্য, আপন স্বার্থ চরিতার্থ করার নেশায় প্রতিপক্ষকে ছুড়ে ফেলছি দূরে। কুৎসিত কদর্যতায় কালিমালিপ্ত করছি অন্যদের। নিজেদের সৃষ্ট শরে নিজেরাই ছিন্নভিন্ন হচ্ছি আমরা। এতে সংসার, সমাজ-সংস্কৃতি সবই যাচ্ছে রসাতলে। যত দিন না এই পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ প্রতিষ্ঠিত হবে তত দিন কিন্তু এ দেশের উন্নতি নেই।

সহকারী প্রধান শিক্ষক, সারগাছি রামকৃষ্ণ মিশন উচ্চ বিদ্যালয়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement