রাজনীতিবিদ নহি, কেবল ধর্মীয় নেতা আমি।’ এই বলিয়া মাটির উপর সাষ্টাঙ্গ প্রণতিতে ক্ষমা চাহিলেন চার্চ অব ইংল্যান্ডের প্রধান আর্চবিশপ অব ক্যান্টারবারি জাস্টিন পোর্টাল ওয়েলবি। ক্ষমা চাহিলেন অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালা বাগে ব্রিটিশ রাজত্বের সেই ঐতিহাসিক হত্যাকাণ্ডের জন্য। ভগবান জিশুর নাম লইয়া বলিলেন, এমন পাপের জন্য তিনি লজ্জিত, পীড়িত। বিশ্বের বহু প্রচারমাধ্যমের কল্যাণে এক দিনের মধ্যে এই ছবি ছড়াইয়া পড়িয়াছে। জালিয়ানওয়ালা বাগের শতবর্ষে ইহা বিরাট প্রাপ্তি, বিশেষত যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অন্যতম নিকৃষ্ট দমনঘটনার জন্য এখনও সরকারি ভাবে ব্রিটেন ক্ষমা চাহে নাই। প্রসঙ্গত, অতীতের জন্য ক্ষমাভিক্ষার প্রথাটি কতখানি সমর্থনযোগ্য, সে বিষয়ে কিছু প্রশ্ন আছে। যাহা অতীত, তাহাকে অতীতে রাখিয়া আসিলেই ভাল, টানিয়াটুনিয়া বর্তমানে আনিতে গেলে দেখা যাইবে পাপী ও পাপের সংখ্যার জটিলতা অন্তহীন। অতীতের ঘটনা লইয়া যাহারা প্রতিশোধে বিশ্বাসী নহে, একই কারণে তাহারা ক্ষমাপ্রার্থনাতেও বিশ্বাস করে না। তবে কি না, কেহ বলিতে পারে, সদর্থক ও নঞর্থক মানসিকতার মধ্যে কিছু ফারাক বাঞ্ছনীয়। দুই প্রজন্ম আগে ক খ-এর প্রতি অন্যায় করিয়াছে বলিয়া আজ খ-কে মারিতে ওঠা আর খ-এর নিকট ক্ষমা চাওয়া, এই দুই কাজ সম্ভবত ক-এর মধ্যে দুই ধরনের প্রবণতাকে নির্দেশ করে— যাহার মধ্যে দ্বিতীয় প্রবণতা পৃথিবীকে একটু হইলেও সুন্দরতর ও প্রসন্নতর করিয়া তুলিতে পারে। সেই জন্যই জুলাই মাসে অ্যাংলিকান চার্চ অব কানাডার আর্চবিশপ যখন কয়েক শতাব্দী পরে সে দেশের নিজস্ব অধিবাসীদের প্রতি নির্দয়তার জন্য ক্ষমা চাহেন, কিংবা খ্রিস্টীয় ধর্মযাজকরা শিশুদের উপর যৌন নিপীড়ন করার জন্য যখন স্বয়ং পোপ ফ্রান্সিস কয়েক বৎসর পর ক্ষমাভিক্ষা করেন— তাহার মধ্যে এক অপার্থিব সৌন্দর্য প্রস্ফুটিত হয়। শত কালিমা ও কলঙ্ক সত্ত্বেও মানুষ এবং তাহার সভ্যতার যে আবারও শোভন-সুন্দর হইয়া উঠিতে বাধা নাই, আরও এক বার সেই বিশ্বাস জন্মে।
আর্চবিশপের আন্তরিক প্রণিপাত যে কাহাকেও করুণনেত্র করিয়া তুলিবে, স্বাভাবিক। কিন্তু ভাবিতে ইচ্ছা করে, তাঁহার প্রণিপাতের বার্তাটি কত দূর পৌঁছাইল। সরকারের মুখপাত্র না হইয়াও যিনি বহুবিগত দিনের সরকারের দুষ্কর্মের কলঙ্ক নিজে স্বীকার করিয়া লইয়া ক্ষমা চাহিতে পারেন, তাঁহার ঔদার্য ও মানবতাবোধের মূল্য কত জন হৃদয়ঙ্গম করিলেন। প্রশ্নটি উঠে এই জন্যই যে মানবতাবোধ বিষয়টি বর্তমান বিশ্বে দ্রুত পরিত্যাজ্য বলিয়া পরিগণিত হইতেছে। ভারতবাসী মাত্রেই আজ আর্চবিশপের ক্ষমাপ্রার্থনায় অভিভূত।
কিন্তু তাঁহাদের কি মনে হইতেছে যে, এই ভারতেই আজ জালিয়ানওয়ালা বাগের নির্দয়তার কাছাকাছি অনেক ভয়ঙ্করতা ঘটিয়া যাইতেছে, যাহার জন্য কোনও নেতা— না রাজনীতির, না ধর্মের— ক্ষমা চাহিতেছেন না, এমনকি কোনও সমবেদনাবাক্যও উচ্চারণ করিতেছেন না। যে কিশোরটি শ্রীনগরের পথে ভারতীয় সেনার গুলিতে প্রাণ হারাইল, একটি মুখের কথাতেও কি তাহার পরিবারকে ভারতীয় নেতারা সমবেদনা জানাইলেন? তবরেজ আনসারি নামে ঝাড়খণ্ডের যে ছেলেটি গণপ্রহারে নিহত হইল, তাহার বিচারে ‘অকাট্য প্রমাণ’-এর অভাবে না-হয় অভিযুক্তরা খালাস পাইয়া গেল, কিন্তু অভিযুক্তরা যে দলের সহিত যুক্ত বলিয়া স্পষ্টত প্রতিভাত, সেই দলের নেতারা কি এক বারও দুঃখপ্রকাশ করিলেন? যে কোনও হত্যাই তো পাপ, সংখ্যার বিচারে তো পাপের বিচার চলে না! তবরেজ আনসারি কিংবা আসরর আহমেদরা তো সে দিনের জালিয়ানওয়ালা বাগের নিহত মানুষগুলি হইতে পৃথক নহেন। আর্চবিশপ দেখাইয়া দিলেন, কাহাকে মানবতা বলে, কাহাকে বলে ‘ধর্ম’। ভারতের নেতারা তাঁহার নিকট ‘ধর্ম’ শিখিয়া লউন।