লন্ডনে নিলামে উঠল এক নব্বই বছরের বৃদ্ধার ছবি, গত ১২ জুন। সৌম্যদর্শন সেই বৃদ্ধার বৈশিষ্ট্য, তিনি এক সময় ছিলেন, আবার ছিলেনও না। ষোলো বছর বয়সের পর আর কেউ তাঁকে দেখেনি, এমনকি তাঁর মৃতদেহও নয়। তবে ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ কিংবা মার্চের শুরুতে তিনি মারা যান, এটা নিশ্চিত। মেয়েটির মৃত্যুর কারণ কী, সেও সঠিক ভাবে বলা যায় না। তাই ১৯২৯ সালের ১২ জুন তাঁর জন্মদিনটি সর্বজনবিদিত হলেও মৃত্যুদিন কারও জানা নেই।
তবু সারা পৃথিবী তাঁকে চেনে। একটি ডায়েরি সেই কিশোরী মেয়েকে ‘হলোকস্ট’-এর যন্ত্রণামুখর দিনগুলির অন্যতম মুখ হিসেবে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছে। কিশোরীর নাম অ্যানলিজ়ে মারি ফ্রাঙ্ক ওরফে অ্যান ফ্রাঙ্ক। স্কটিশ শিল্পী কম্পিউটারে ছবি এঁকে দেখাতে চেয়েছেন সদ্য নব্বইতে পা দেওয়া অ্যান ফ্রাঙ্ক যদি তাঁর জন্মদিনটি পালন করতে পারতেন, তাঁকে দেখতে কেমন হত।
ওলন্দাজ ইহুদি ফ্রাঙ্ক পরিবার যখন ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে এসে আমস্টারডামে বসত গড়ে, অ্যানের বয়স তখন মাত্র চার বছর। নাৎসি জার্মানির গ্রাস থেকে শেষ পর্যন্ত বাঁচতে পারেননি তাঁরা। হিটলার নেদারল্যান্ডস দখল করেন ১৯৪০ সালে। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৪, এই দু’বছর কর্মচারীদের সহায়তায় অফিস ঘরের পিছনে গোপন স্থানে লুকিয়ে থাকতে হয় তাঁদের। তাও শেষরক্ষা হয়নি। সকলেই গ্রেফতার হয়ে গেলেন ১৯৪৪ সালের ৪ অগস্ট। প্রথমে আউশভিৎজ়, পরে বের্গেন-বেলসেন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। মা আগেই মারা যান অনাহারে। দিদি চলে গেল প্রবল টাইফয়েডে। তার পর অ্যানের পালা।
তেরো বছরের জন্মদিনে অ্যান একটি ডায়েরি উপহার পেয়েছিলেন। গোপন, প্রায় নিঃসঙ্গ জীবনে সেই ডায়েরি হয়ে উঠল তাঁর বন্ধু ‘কিটি’। নীল ডায়েরির পাতায় অ্যান ব্যক্ত করেছেন তাঁর চিন্তা, তাঁর অভিমান, যন্ত্রণা, আনন্দ, প্রেম, এমনকি প্রথম চুম্বনের অভিজ্ঞতাও। বড় হলে হয়তো প্রখ্যাত সাহিত্যিক হতে পারতেন, কিন্তু বড়ই তো হওয়া হল না তাঁর। যুদ্ধশেষে শূন্য ঘরে ফিরলেন পরিবারের একমাত্র জীবিত সদস্য, অ্যানের বাবা ওটো ফ্রাঙ্ক। তাঁর সেক্রেটারি মিয়েপ গিয়েস গ্রেফতারির দিনই খুঁজে পেয়েছিলেন অ্যানের ডায়েরি। ওলন্দাজ ভাষায় তা বই হিসাবে প্রকাশিত হল ১৯৪৭ সালে। ১৯৫২ সালে আমরা ইংরেজিতে পড়তে পেলাম, ‘দ্য ডায়েরি অব আ ইয়াং গার্ল’।
মুণ্ডিত মস্তক, নগ্নদেহী যে লক্ষ লক্ষ বন্দিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ঢোকানো হয়েছিল, তাঁরা শতাব্দীর সবচেয়ে দুর্ভাগা মানুষ। কেউ মরেছেন গুলি খেয়ে, প্রবল অত্যাচারে বা অনাহারে, কেউ গিয়েছেন গ্যাস চেম্বারে। এই সব ক্যাম্প ‘হলোকস্ট’-এর নরক, যেখানে মানুষ প্রবেশ করেছে আর বেরিয়ে এসেছে শুধুই আর্তনাদ। সেই ইনফার্নো পেরিয়ে এসে এক না-থাকা মেয়ে আজও পৃথিবীর তারুণ্য জুড়ে ভীষণ ভাবে থেকে যেতে পেরেছেন তাঁর ডায়েরির মাধ্যমে, তাঁর অদম্য জীবন-পিপাসায়। তাই নব্বই না ছুঁয়েও নব্বই বছরে পড়লেন অ্যান ফ্রাঙ্ক।
শুধু লন্ডন নয়, পৃথিবীর অনেক শহরে পালিত হয়েছে অ্যানের জন্মদিন। ইটালিতে তাঁর লেখার ইটালীয় অনুবাদ পড়ে শোনালেন নব্বই জন খ্যাতনামা ব্যক্তি। লেখক, শিল্পী, খেলোয়াড় থেকে শুরু করে রাজনীতিক, সকলেই ছিলেন সেই দলে। জার্মানিতেও অনুষ্ঠান হল বেশ কয়েকটি। সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত সৃষ্টি করলেন অ্যানের সহপাঠী বন্ধুরা। তাঁরই বাড়িতে তাঁরা বসলেন স্কুলের বাচ্চাদের সঙ্গে। ছিলেন জ্যাকলিন ভান মার্সেন, ছিলেন আলবার্ট গোমস দে মেসকিটা। এঁরা অ্যানের সেই তেরো বছরের জন্মদিনের অনুষ্ঠানেও উপস্থিত ছিলেন, যে বার শেষ বারের মতো নিজের জন্মকে স্বাগত জানিয়েছিলেন অ্যান ফ্রাঙ্ক। পরের জন্মদিন হয়তো হয়ে উঠেছিল মৃত্যুর চেয়েও যন্ত্রণার।
নব্বই ছোঁয়া মানুষগুলি স্মৃতির পাতায় আঁকলেন সেই সবুজ কৈশোর আর ন’-দশ বছরের শিশুরা সতৃষ্ণ চেয়ে রইল তাঁদের সজল চোখের দিকে। ঠিক যেমন লুকোনো জানালা দিয়ে আকাশ দেখতে চাইতেন অ্যান ফ্রাঙ্ক।
গত বছর মৃত্যু শতবর্ষ গিয়েছে কবি উইলফ্রেড আওয়েনের। এ বছর নব্বই ছুঁলেন সম্ভাবনাতেই শেষ হয়ে যাওয়া অ্যান ফ্রাঙ্ক। নেই বলেই হয়তো দশ বছর পরে শতবর্ষে আরও বেশি করে থাকবেন তিনি। কারণ আওয়েন বা অ্যানের স্মৃতির সঙ্গে মিলেমিশে রয়ে গিয়েছে যুদ্ধ, রাষ্ট্র নির্মিত তারুণ্যের কসাইখানা। কাজেই স্মৃতিস্তম্ভে সাদা ফুল দিতে দিতে আমাদের চোখ চলে যায় বিভিন্ন জাতীয় পতাকায় মোড়া আরও অনেক দেহের দিকে, যাঁদের স্মৃতিতে আবার নির্মিত হবে স্তম্ভ।
মাত্র কয়েক দিন আগে আমাদের দেশ কাশ্মীরে নিহত মেজর আরশাদ খানের শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে চোখের জল ফেলতে দেখেছে এক পুলিশকর্মীকে। শিশুটির অদূরে পতাকায়, মালায় ঢাকা অবস্থায় নিথর শুয়েছিলেন তার বাবা। কাল যদি তাকেও জন্মদিনে কেউ একটা নীল ডায়েরি দেয়, সে যেন তাতে যুদ্ধের বৃত্তান্ত না লেখে, এই আমাদের আশা। অ্যান ফ্রাঙ্কের জন্মদিনে সেই আশাটুকুই পৃথিবীর উপহার হোক।
ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।